বেসরকারি সংস্থাগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে সরকারের প্রতি আহ্বান

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের জন্য যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য দরকার। আর এ জন্য এই মুহূর্তে দরকার বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগানো। এমন পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সংগঠনগুলোর জোট ‌‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ’।

আজ শনিবার প্ল্যাটফর্মটির পক্ষ থেকে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ ছাড়া আলোচনায় অংশ নেন সিপিডির আরেক বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রমুখ।
প্ল্যাটফর্মটি সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার কাজ করছে বলে জানানো হয়। এর সঙ্গে ১০০টি সংস্থা জড়িত। গত এক সপ্তাহে তারা দেশব্যাপী নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে।
স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্ল্যাটফর্মের ৪০টি সহযোগী সংস্থা ৬০০ কোটি টাকা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না, এ দর্শন বিবেচনায় রেখে জ্যেষ্ঠ নাগরিক, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, দরিদ্র নারী-শিশু, যুব শ্রেণি, দলিত জনগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, ভাসমান জনগোষ্ঠী, যৌনকর্মী পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অনেকের বসবাস ফুটপাতে। প্রতিবন্ধীরা এমনকি কোথাও যেতেও পারছে না। অনেকে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে শিশু অবস্থায়ও। অনাবাসী শ্রমিকেরা দেশে ফিরে অনেক ক্ষেত্রে অন্যদের মাধ্যমে পরিত্যক্ত হয়ে আছেন। শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। বাড়ছে বেকারত্ব। অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। কিন্তু চেতনার কাগজ যাদের কাছে দেওয়া হচ্ছে, চেতনাবৃদ্ধিকারী ওই সব দলিল বঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে যাচ্ছে না।
সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও অনেক ক্ষেত্রে তা কাজে আসছে না বলে জানান দেবপ্রিয় ভট্টার্চায। বলেন, সব ধরনের পরিবহনব্যবস্থা বন্ধ থাকার কারণে পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছে। ভেঙে পড়ছে কৃষি সক্ষমতা ও মনোবল। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে হলেও গ্রাম থেকে কৃষিপণ্য শহরে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। আর ব্যক্তি খাতে খাতওয়ারি অনেক সংগঠন ও চেম্বার রয়েছে। তাদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা দরকার। যদিও ক্ষুদ্রদের কাছে প্রণোদনার ঋণ যাওয়া কঠিন।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে অশনিসংকেতের কথা তুলে ধরে প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে বলা হয়, শুধু চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কথা বলা হচ্ছে। নার্স, চিকিৎসকদের সহকারী, টেকনিশিয়ান, এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মী যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সুরক্ষার কথাও সমান গুরুত্ব দিয়ে বলতে হবে।
সভায় আরও বলা হয়, দুঃখজনক হলেও সত্য যে মহামারির এই সময়ে সমাজে নতুন কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে। এদিকে নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহ বেড়েছে। এ–বিষয়ক হেল্পলাইনগুলো খোলা থাকলেও আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ। আশঙ্কা করা হচ্ছে মহামারির কারণে স্কুল থেকে ঘরে যাওয়া বাড়বে। আর বাড়বে যুবসমাজের মাদক সেবন ও জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা।

এমন বাস্তবতায় এসডিজি বাস্তবায়নে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের পরামর্শ দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থা দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা উচিত হবে না বলে মত দেন তিনি। দেবপ্রিয় বিশ্বাস করেন মহামারির প্রকোপ রোধে এই ফান্ডের জন্য বৈদেশিক সাহায্য আনা সম্ভব হবে।
প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনটি করণীয় আছে এখন। প্রথমত, তৃণমূল পর্যায়ে যারা কাজ করেছে, তাদের অভিজ্ঞতাগুলোকে একটি জায়গায় নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা এবং তৃতীয়ত সরকারি সহযোগিতা ঠিকমতো যথাজায়গায় পৌঁছাল কি না, তা যাচাই করতে সামাজিক জবাবদিহিমূলক কাঠমো গঠনের উদ্যোগ নেওয়া।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। চা-শ্রমিক, চরাঞ্চল ও হাওরাঞ্চলে সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম বলতে গেলে যায়ইনি।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরাসরি আর্থিক সহায়তা অনেক দেশই দিচ্ছে। সিপিডি আগেই এই পরামর্শ দিয়েছে। ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে আট হাজার টাকা করে দিলে মোট দেশজ উদপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ ব্যয় হবে।
বেসরকারি সংস্থাগুলোকে কাজে লাগানো হলে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোকে দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে জানান তিনি।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, এই যে অনাবাসী শ্রমিকদের একঘরে ফেলা হচ্ছে, বাড়িওয়ালারা চিকিৎসক-নার্সদের বের করে দিতে চাচ্ছেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, এগুলোর জন্য শীর্ষ পর্যায় থেকে কমন একটা বার্তা থাকা উচিত, যা সারা দেশে প্রচারণার কাজে লাগানো যাবে।
ট্রাস্ট ফান্ড হলে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের যুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রশ্নোত্তর পর্বে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একটি ভালো তথ্যভান্ডার যে কত গুরুত্বপূর্ণ, করোনাভাইরাস তা দেখিয়ে যাচ্ছে। আর শুধু করোনাভাইরাস নয়, ক্ষুধায়ও আক্রান্ত।