ব্যর্থতার বৃত্তেই নির্বাচন কমিশন

>
  • তিন সিটি নির্বাচন
  • নির্বাচন কমিশন বলেছিল, নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।
  • তারা নির্বাচনটি অবাধ করেছে, তবে দলবিশেষ ও প্রার্থীবিশেষের পক্ষে।

তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী কাণ্ড করল। এমন আরেকটি কাণ্ড ঘটেছিল খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে মাগুরা উপনির্বাচনে। সে নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ বলেছিলেন, নির্বাচনে কেউ মাস্তানি করলে কমিশন তিন গুণ মাস্তানি করে তা মোকাবিলা করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রউফ সাহেব নিজেই সে মাস্তানির কাছে নতিস্বীকার করে মাগুরা থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলেন।

এবার সিইসি হুদা কিংবা তাঁর কোনো সহযোগী কমিশনার নির্বাচনের দিন কোনো নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি বা সাহস পাননি। নির্বাচনের আগে শুধু বুড়ি ছোঁয়ার মতো করে তাঁরা তিন সিটিতে যেন আনন্দভ্রমণ করে এসেছেন।

এবারের নির্বাচনে তিন সিটিতে তিন চিত্র। সিলেটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও বিএনপির আরিফুল হকের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আরিফুল হক সাড়ে চার হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলেন। দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত থাকায় রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করতে পারেননি।

রাজশাহীতে বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ব্যাপক ভোট কারচুপি, জবরদস্তি ও নির্বাচনী এজেন্টদের বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে নিজে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং একটি কেন্দ্রের মাঠে সাড়ে চার ঘণ্টা অবস্থান নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। সেখানে শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন শিবিরে ছিল বিজয়ের উল্লাস। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সবার আগে ঘোষণা করা রাজশাহীর ফলে দেখা যায়, বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৯০ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন। ২০১৩ সালে বুলবুল বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন।

সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল। সেখানে প্রায় সব কেন্দ্রে ভোর থেকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে দখলদারি শুরু হয়। পরিস্থিতি নাজুক দেখে বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে বাসদ, ইসলামী আন্দোলন, সিপিবির প্রার্থীও ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। সর্বশেষ ফলাফলে দেখা যায়, বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের চেয়ে আট গুণ বেশি ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তথ্য বলে, ১৯৭৩ সালের পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বরিশাল কোনো নির্বাচনেই সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিততে পারেননি। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনে সারা দেশে বিএনপির ভরাডুবি ঘটলেও মজিবর রহমান সরোয়ার আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন। এবার তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ১ লাখ ৭ হাজার ভোটের বিপরীতে ১৩ হাজার ভোট পেয়েছেন। সেখানে এত ভৌতিক ভোট আসার কিছু চিত্র গণমাধ্যমে এসেছে।

নির্বাচন কমিশন বলেছিল, নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। হ্যাঁ, তারা নির্বাচনটি অবাধ করেছে, তবে দলবিশেষ ও প্রার্থীবিশেষের পক্ষে। অন্যদের জন্য কঠিন করে তুলেছিল। এক মেয়র প্রার্থী তবু মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন, অন্য দুজন টিকতে না পেরে নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছেন।

খুলনা সিটি করপোরেশনে ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন হওয়ার পর অনেকেই আশা করেছিলেন গাজীপুরের ভোটটি হয়তো ভালো হবে। তা হয়নি। বরং গাজীপুরে খুলনার আড়াল সরিয়ে ভোটকেন্দ্রে বিশেষ এক প্রার্থীর পক্ষেই ব্যাপক দৌরাত্ম্য ঘটে। তারপরও বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটের নির্বাচনে ভিন্নতর কিছুর ক্ষীণ একটি আশা মানুষের মধ্যে ছিল। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা, হামলা, নির্বাচনী এজেন্টদের বের করে দেওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সে আশা নির্বাপিত হলো।

নির্বাচন কমিশন দাবি করেছিল, তিন সিটির নির্বাচন খুলনা ও গাজীপুরের মতো হবে না। সত্যিই তা হয়নি। হয়েছে তার চেয়েও খারাপ, বিশেষত বরিশাল ও রাজশাহীতে। বহু কেন্দ্রে ভোটাররা গিয়ে দেখেছেন তাঁদের ভোটটি দেওয়া সারা। কোথাও ভোটাররা লাইনে থাকা অবস্থাতেই ব্যালট পেপার শেষ। সেই শুভংকরের অঙ্কেই প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে আট গুণ বেশি ভোট। অভূতপূর্ব এই নির্বাচনী কৃতিত্বের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ‘ধন্যবাদ’ না জানিয়ে উপায় কী!