ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন: বাড়িঘরের পর এবার বিলীনের পথে সড়ক

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ধসে গেছে সড়কটির একপাশ। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মরিচারচর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ধসে গেছে সড়কটির একপাশ। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মরিচারচর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

পড়ন্ত বিকেল। নিজের বাড়ির সামনে বসে আছেন ৭১ বছর বয়সী গিয়াস উদ্দিন। তাঁর চোখ বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্রের খরস্রোতে। তীব্র বাতাসের ঝাপটায় নদের ঢেউ বাড়ির আঙিনায় উঠে পড়ছে। বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া পাকা সড়কটির অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।

গিয়াস উদ্দিনের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদঘেঁষা মরিচারচর গ্রামে। তিনি জানান, ১৯৮৪ সাল থেকে নদীভাঙনের শিকার। তিনবার ভেঙেছে তাঁর বসতবাড়ি। ভাঙনে তলিয় গেছে ফসলের জমি। সর্বশেষ ২০১১ সালে তৃতীয়বার নদীভাঙনে বাড়িটি বিলীন হয়ে গেলে বর্তমান বাড়িটি তৈরি করেন। এটিও এখন ভাঙনের মুখে।

গিয়াস উদ্দিনের মতো মরিচারচর গ্রামের আরও অনেক পরিবার গত ১০ বছরে নিজেদের বসতবাড়ি হারিয়েছেন। এ বছরও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ২৯টি বাড়ি বিলীন হয়েছে বলে গ্রামবাসী জানায়। বাড়িঘর বিলীন হওয়ার পর এবার ভাঙতে শুরু করে গ্রামের মানুষদের চলাচলের একমাত্র পাকা সড়কটি।

বৃহস্পতিবার বিকেলে মরিচারচর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বটতলা মোড় থেকেই উত্তর মরিচারচর পর্যন্ত আনুমানিক চার কিলোমিটার পাকা সড়কের প্রায় অর্ধেক অংশই নদীভাঙনের কবলে পড়েছে। বটতলা মোড় থেকে আনুমানিক দুই কিলোমিটার অংশজুড়েই অসংখ্য স্থানে পাকা সড়কের অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ওই সব অংশে ঝুঁকি নিয়ে রিকশা, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে।

গ্রামের বাসিন্দারা জানান, নদের এ ভাঙন অন্তত ৩০ বছর আগে শুরু হয়। গত ৮ বছরে এ ভাঙন তীব্রতা পায়। এতে নদীর গতিপথই বদলে গেছে। গত ৩০ বছরে নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে শতাধিক বাড়িঘর। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো কেউ কেউ নিজেদের জমিতে আবার কেউ কেউ অন্যের জমিতে নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছেন।

উত্তর মরিচারচর অংশে চলতি বছর বেশি ভেঙেছে বলে জানান গ্রামবাসী। সেখানে গিয়ে কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, এ বছর নদীভাঙনে ২৯টি বাড়ি বিলীন হয়েছে। ভাঙনের শিকার আজিজুল হক বলেন, মাসখানেক আগে ব্রহ্মপুত্র নদে বিলীন হয়ে যায় তাঁর বাড়ি। বিলীন হওয়া বাড়ির পাশেই আপাতত একটি বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে তাঁর পরিবার। সরকারিভাবে টিন ও বাড়ি নির্মাণের জন্য ৬ হাজার টাকা পেয়েছেন তিনি। কিছু চাল-ডাল পেলেও ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। তিনি নিজে ভ্যান চালিয়ে উপার্জন করেন।

গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, ভাঙনে বাড়িঘর বিলীনের পর গ্রামের একমাত্র সড়কটিও ভাঙনের কবলে পড়ায় তাঁরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। চর এলাকার হাজারো মানুষ প্রতিদিন এ সড়কটি দিয়ে চলাচল করে। নিজেদের উৎপাদিত বেগুন, মরিচসহ নানা ধরনের সবজি তাঁরা শহরে নিয়ে যান। গ্রামবাসী বলছেন, ওই এলাকায় সরকারিভাবে ব্রহ্মপুত্র নদে খননকাজ চলছে। খননকাজ নদের মূলধারায় হচ্ছে না। ওই খননকাজ নদের মূলধারায় হলে ভাঙন রোধ হতে পারে। এ দাবিতে সম্প্রতি মরিচারচর গ্রামের মানুষ মানববন্ধন করেছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙনের কারণে সড়কটি দিয়ে চলাচল করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঝুঁকি নিয়ে চলছে রিকশা ও ইজিবাইক। ভেঙে যাওয়া কয়েকটি স্থানে সরকারিভাবে বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। তবে তাতে ভাঙনের ঝুঁকি পুরোপুরি কমেনি। গ্রামবাসীর আশঙ্কা, পানি কমতে শুরু করলে এ ভাঙন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেতে পারে।

জানতে চাইলে ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্পের পরিচালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, গ্রামবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খননের নকশায় কিছুটা পরিবর্তন করতে হবে। নকশা পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত অনুমতি চাওয়া হয়েছে। এতে ভাঙন ৮০ ভাগ কমে যেতে পারে।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন বলেন, এ বছর ওই এলাকার ২৭টি বাড়ি ও ২০ একর জমি নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। নদীভাঙন রোধে এবং সড়কটি টিকিয়ে রাখতে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) চার দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে মরিচারচরে নদীভাঙন রোধ হবে বলে তিনি মনে করেন।