ব্রাহামায় যে কারণে আপত্তি বাংলাদেশের
ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ বলছে, জীবন্ত পশুপাখি বিমানবন্দরে অবতরণের অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগেই আমদানিকারকেরা দাপ্তরিক সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রাখেন। কিন্তু সম্প্রতি তারা ব্রাহামা প্রজাতির যে ১৮টি গরু তারা জব্দ করেছে, সেগুলো ছাড় করানোয় কোনো তৎপরতা নেই আমদানিকারকদের। গরুগুলোর দামও নেহাত কম নয়, খরচ পড়েছে ৪০ হাজার ডলার বা ৩৪ লাখ টাকা।
এর আগেও ‘ফ্রিজিয়ান’ ঘোষণা দিয়ে আমদানিনিষিদ্ধ ব্রাহামা প্রজাতির ৩০টি গরু ঢাকায় এনেছিল ডেইরি সান নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ গরুগুলো জব্দ করে। বিমানবন্দরে অত গরু রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। পরে নিয়ম অনুযায়ী জব্দ গরুগুলো সাভারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় গোপ্রজনন ও দুগ্ধ খামারে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মাস দেড়েক বাদে আদালতের নির্দেশে অধিদপ্তর গরুগুলো ফিরিয়ে দেয়। এবারকার ১৮টি গরু টেক্সাস থেকে টার্কিশ এয়ারলাইনসের কার্গোতে এসেছে। প্রাপকের ঠিকানায় সাদেক অ্যাগ্রো, মোহাম্মদপুর লেখা। সোমবার পর্যন্ত গরুর খোঁজ কেউ নেয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা কাস্টম হাউসের উপকমিশনার মোহাম্মদ আবদুস সাদেক। তিনি জানান, এগুলোকেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সাভারে পাঠানো হয়েছে। পরে কী হবে, কেউ বলতে পারছে না।
প্রশ্ন উঠেছে, ‘ব্রাহামা’ নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তির কারণ কী?
কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রাহামা’র উৎপত্তি ভারতে। পরে যুক্তরাষ্ট্রে আরও দু-তিনটি জাতের সংমিশ্রণে এটিকে উন্নত করা হয়। এ জাতের গরু লালন-পালন করা হয় মূলত মাংসের জন্য। উচ্চ তাপমাত্রায় ভালো থাকে এরা, রোগবালাই কম, বাড়েও দ্রুত। কিন্তু গাভির দুধ উৎপাদনক্ষমতা খুবই কম। সে কারণেই বাংলাদেশে ব্রাহামা জাতের গরুর উৎপাদনকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না।
প্রশ্নের জবাবে এই অধ্যাপক জানান, বাংলাদেশ চাইছে এমন গরু, যেটি একই সঙ্গে মাংস ও দুধের চাহিদা পূরণ করবে। দেশে বাণিজ্যিক উৎপাদনে থাকা খামারিরা হোলস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের গরু পালেন। ফ্রিজিয়ান নেদারল্যান্ডসের গরু।
যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডে ফ্রিজিয়ান গরুর সংকর করে হোলস্টেইন জাত তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে এই জাত আমদানি করে থাকে। এই প্রজাতির গাভি দিনে ৬ থেকে ৩০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। আর এই জাতের ষাঁড়ের ওজন ৮০০ থেকে ১ হাজার কেজি। এর বাইরেও সিন্ধি ও শাহিওয়াল—এই দুই প্রজাতির গরুও পালন করা হয়। কোরবানির জন্য গ্রামাঞ্চলের শাহিওয়াল গরুর চাহিদা আছে বেশ। অন্যদিকে ব্রাহামা প্রজাতির ষাঁড়ের ওজন ১ হাজার ৪০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিদিন দেড় কেজি পর্যন্ত ওজন বাড়ে এর।
কিন্তু সমস্যাটা হলো ব্রাহামা প্রজাতির গাভি দিনে তিন-চার লিটারের বেশি দুধ দেয় না। যতটা দুধ দেয়, তাতে শুধু বাছুরের চাহিদাটুকু মেটে। কিন্তু প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মাংসেরও প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে ব্রাহামাকে অনুমোদন দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন শাখা বিভাগের পরিচালক ভবতোষ কান্তি সরকার প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই ব্রাহামাকে অনুমোদন দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, দুগ্ধ উৎপাদনে বাংলাদেশের একটা লক্ষ্যমাত্রা আছে। এখন দেশে ১০৬ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়। ১০ বছরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ২০০ লাখ মেট্রিক টন। অন্যদিকে দেশে মাংসের চাহিদা ৭৬ লাখ টন, এখন উৎপাদিত হচ্ছে ৭৬ দশমিক ৭৪ লাখ টন। ফ্রিজিয়ান জাতের গরুর সংখ্যা বাড়িয়ে একই সঙ্গে দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে তাঁরা মনে করছেন।
ব্রাহামা পালন শুরু হলে দুগ্ধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
অধিদপ্তর জানাচ্ছে, তারা শুক্রাণু আমদানি করে নির্ধারিত কিছু জায়গায় গবেষণার জন্য কাজ শুরু করেছিল। তবে এর ফল খুব ভালো পাওয়া যায়নি। হোলস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের গাভির সঙ্গে ব্রাহামার সংকরায়ণে বরং ক্ষতিই হচ্ছিল। এঁড়ে বাছুরের দুধের চাহিদা অনেক, আর যে মেয়েবাছুরের জন্ম হচ্ছিল, সেটিও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দুধের উৎপাদন করতে পারছিল না। হৃষ্টপুষ্ট ব্রাহামা ষাঁড় দেখে খামারিদের অনেকেই সংকরায়ণের প্রযুক্তি গোপনে হস্তগত করেন। এমন একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর তাদের ওই প্রকল্প আর দীর্ঘায়িত করেনি।
তবে ব্রাহামা গরু বাংলাদেশের জন্য ভালো নয় বলা হলেও প্রভাবশালী বিক্রেতাদের কেউ কেউ কিন্তু রীতিমতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েই আমদানিনিষিদ্ধ গরু নিয়ে আসছেন।