ব্রিটিশ আমলের বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমি

মোগল ও ইউরোপীয় শৈলীর সংমিশ্রণে তৈরি ঢাকার ঔপনিবেশিক আমলের একটি বিখ্যাত স্থাপনা বর্ধমান হাউস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বহু মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনার সঙ্গে বর্ধমান হাউসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই বর্ধমান হাউসের একটি পুরোনো ছবিও পাওয়া গেল বাংলা একাডেমির কাছ থেকে। ব্রিটিশ আমলে শাহবাগে ঢাকার নবাবদের যত স্থাপনা ছিল, সুজাতপুর প্যালেস তার একটি। এটিই পরে বর্ধমান হাউস হয় বলে কথিত আছে। ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ-এ বলা হয়েছে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসন পরিষদের তিন সদস্যের একজন অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের মহারাজা স্যার বিজয় চাঁদ মাহতাব ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত সময়ে কিছুকাল এই বাড়িতে থাকতেন বলে এর নাম হয় বর্ধমান হাউস। বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের কারণে বর্ধমান হাউস তার আদিরূপ কিছুটা হারিয়েছে। ১৯৬২ সালে সংস্কারের সময় এটি তৃতীয় তলা করা হয়। বর্ধমান হাউসের নিচতলার দক্ষিণ দিকের একটি কক্ষ মূল্যবান কাঠ দ্বারা আচ্ছাদিত। জনশ্রুতি আছে, এটি নাচঘর ছিল। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ‘বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি দিন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার ও কাজী মোতাহার হোসেন এই ভবনে বসবাস করেছেন। এ দুই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বাংলার দুই মহান সাহিত্যস্রষ্টা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এর মধ্যে ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি হিসেবে বর্ধমান হাউসে কয়েক দিন অবস্থান করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর বর্ধমান হাউস পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়। যুক্তফ্রন্টের প্রস্তাবিত ২১ দফার একটি ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসে থাকবেন না। এখানে বাংলা ভাষার গবেষণাগার করতে হবে। এরপর ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর এখানে বাংলা একাডেমি উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে এই ভবনে বাংলা একাডেমির একুশে সংগ্রহশালা, পাঠাগার, ফোকলোর বিভাগসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে বর্ধমান হাউসের চারটি কক্ষে স্থাপিত হয় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর। যাঁরা কখনো দেখেননি, তাঁরা বইমেলায় ঘুরতে এসে দেখে যেতে পারেন এই জাদুঘর।
লেখা: শরিফুল হাসান, ছবি: হাসান রাজা