ব্রুসেলোসিসের টিকা উদ্ভাবন

ব্রুসেলোসিস ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। এটি এমন একটি ছোঁয়াচে জুনোটিক রোগ, যা পশু থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে পশুতে ছড়ায়। গবাদিপশুর ভ্রূণ নষ্ট, অকালে গর্ভপাত, বন্ধ্যত্ব এবং অনেক সময় মানুষ ও পশুপাখির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই রোগ। রোগের জীবাণুর অ্যান্টিজেনিক ভ্যারিয়েশন থাকায় এ রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশে অন্য দেশের উদ্ভাবিত টিকা কোনো কাজ করত না।

দেশে শনাক্তকারী জীবাণু প্রতিরোধে প্রথমবারের মতো ব্রুসেলোসিস রোগের টিকা (ভ্যাকসিন) উদ্ভাবনের দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। গত সোমবার নিজ বিভাগের সম্মেলনকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।

প্রাণী ও মানবদেহে ছোঁয়াচে রোগগুলোর মধ্যে সংক্রমণের দিক থেকে যক্ষ্মা ও অ্যানথ্রাক্সের পরেই ব্রুসেলোসিসের অবস্থান। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে টিকা তৈরির গবেষণা শুরু করেন গবেষক। জীবাণুর ভ্যারিয়েশন শনাক্তের পর ‘হিট ফিল্ড ভ্যাকসিন’ উদ্ভাবন করলেন তিনি। সম্প্রতি গবেষকের এই টিকা সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ যুক্তরাজ্যের ইসি ভেটেরিনারি সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে ১৯৬৭ সালে গরুতে, ১৯৮৩ সালে মানুষ ও ছাগলে, ১৯৯৭ সালে মহিষে, ২০০৭ সালে ভেড়ায়, ২০১২ সালে শূকরে ও ২০১৮ সালে ঘোড়াতে ব্রুসেলোসিস রোগ শনাক্ত করা হয়। উন্নত দেশে ব্রুসেলোসিস রোগ প্রতিরোধে এস-১৯ এবং আরবি-৫১ নামে দুটি টিকা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে রোগের জীবাণুর অ্যান্টিজেনিক ভ্যারিয়েশন থাকায় এসব টিকা তেমন কোনো কাজ করে না। পৃথিবীতে মোট আটটি ভ্যারিয়েশন রয়েছে, যার মধ্যে বায়োভার-৩ দিয়ে দেশের গবাদিপশু আক্রান্ত হয়।

টিকা উদ্ভাবন সম্পর্কে গবেষক বলেন, গর্ভপাত হওয়া গাভির মৃত বাচ্চা ও গর্ভফুল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে জীবাণুকে আলাদা করা হয়। গবেষণার মাধ্যমে এই জীবাণুকে অকার্যকর করা হয়, যেন তা প্রাণীদেহে রোগ সৃষ্টি করতে না পারে। এরপর টিকা হিসেবে কার্যকারিতা অবলোকন করার জন্য গিনিপিগে প্রয়োগ করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, টিকা প্রয়োগের আট সপ্তাহ পর্যন্ত গিনিপিগে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পাওয়া যায়। এই টিকাকে আরও কার্যকর ও মানসম্মত করতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

সম্প্রতি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিরাময় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ছয়টি সংক্রামক রোগের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে বলেছে। এর মধ্যে একটি হলো ব্রুসেলোসিস। আর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, মানুষ যেসব রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, এর ৭৫ শতাংশই আসে গবাদিপশু থেকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জলাতঙ্ক, অ্যানথ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস, যক্ষ্মা, নিপা ও অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা।

ব্রুসেলোসিস রোগের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে বিগত ১৫ বছর ধরে এই রোগের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে আসছেন সিদ্দিকুর রহমান। টিকা উদ্ভাবনের মাধ্যমে গবাদিপশুর গর্ভপাত ও মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করেন গবেষক। তিনি বলেন, উদ্ভাবিত টিকা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হলে খামারিরা আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাবেন। এখন বিভিন্ন পশুর শরীরে প্রয়োগের মাত্রা ও কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করছেন। ইতিমধ্যে গরুতে এই টিকা প্রয়োগ করেছেন।

২০০৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার চুনবুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ব্রুসেলা বায়োটাইপ ও ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন সিদ্দিকুর রহমান। তিনি তিনবার রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। ব্রুসেলোসিস নিয়ে দেশি-বিদেশি সাময়িকীতে তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বলে জানান এই গবেষক।