ব্লাস্ট-প্রতিরোধী গমের নতুন জাত

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের দাবি, নতুন এই জাত ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধে শতভাগ কার্যকর।

গম খেত
ফাইল ছবি

ব্লাস্ট-প্রতিরোধী গমের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিডব্লিউএমআরআই)। ইতিমধ্যে জাতীয় বীজ বোর্ড জাতটি অনুমোদন দিয়েছে। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘ডব্লিউএমআরআই গম-৩’। আগামী বছর থেকে চাষের জন্য এই জাতের গমবীজ কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে।

ডব্লিউএমআরআইয়ের গম গবেষকেরা বলছেন, জাতীয় বীজ বোর্ড এ পর্যন্ত গমের ‘ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী’ দুটি জাতের অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী গমের একটি জাত উদ্ভাবন করে। ২০১৭ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী জাত হিসেবে ‘বারি গম-৩৩’ নামে জাতটিকে অনুমোদন দেয়। এই জাত ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। আর নতুন উদ্ভাবিত ডব্লিউএমআরআই গম-৩ জাতটি ৯৯ দশমিক ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সদস্য পরিচালক (বীজ ও উদ্যান) মো. মোস্তাফিজুর রহমান জাতীয় বীজ বোর্ডেরও সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডব্লিউএমআরআই গম-৩ জাতটি ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী জাত হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর থেকে জাতটি কৃষক পর্যায়ে আসবে।

বিডব্লিউএমআরআইয়ের গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিমিট) চারটি জাতের সঙ্গে সংকরায়ণের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল গমের এই জাত পাওয়া গেছে। এটি গমের ব্লাস্ট রোগ, পাতার দাগ রোগ ও মরিচা রোগপ্রতিরোধী এবং তাপসহিষ্ণু। জাতটি প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল। এর জীবনকাল ১০৮-১১৪ দিন। জাতটির গাছ শক্ত, শিষ লম্বা এবং প্রতি শিষে দানার সংখ্যা ৪৮-৫৪টি। দানার আকার মাঝারি, রং সাদা চকচকে এবং হাজার দানার ওজন ৪২-৪৬ গ্রাম। গাছের রং গাঢ় সবুজ। উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন চার থেকে পাঁচ মেট্রিক টন।

জাতটি ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বপনের উপযুক্ত সময়। তবে মধ্যম মাত্রার তাপ সহনশীল হওয়ায় এটি ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে বপন করলে অন্য জাতের তুলনায় বেশি ফলন পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে জাতটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। রবি মৌসুমে দেশের ১৩টি স্থানে জাতটির মাঠপর্যায়ে গবেষণা হয়। গমের এ জাতের চূড়ান্ত মাঠ পরীক্ষা হয় বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট যশোর আঞ্চলিক কেন্দ্রে। ল্যাবরেটরি পরীক্ষা হয় বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয় দিনাজপুর এবং বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি গাজীপুরে। এরপর গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৩তম সভায় ‘ডব্লিউএমআরআই গম-৩’ নামে গমের এই জাতকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

* গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৩তম সভায় ‘ডব্লিউএমআরআই গম-৩’ নামের এই জাতকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। * এ বছর ভিত্তি বীজ উৎপাদনের জন্য বিএডিসিকে ব্রিডার সিড দেওয়া হবে। আবাদের জন্য আগামী বছর বীজ কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল ও ভোলায় গমে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ৭টি জেলার প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমির গম এ রোগের আক্রমণের শিকার হয়। এতে গমের উৎপাদন এক–তৃতীয়াংশ কমে যায়। কৃষকেরা মূলত বারি গম-২৬ জাতটি বেশি পরিমাণে চাষ করেন। ওই জাতের গমে ব্লাস্ট ব্যাপক আকারে আক্রমণ করে।

কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গমের ব্লাস্ট একটি ক্ষতিকর ছত্রাকজনিত রোগ। গমের শিষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে তুলনামূলক গরম ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া থাকলে এ রোগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। প্রধানত গমের শিষে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। শিষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে। আক্রান্ত স্থানের ওপরের অংশ সাদা হয়ে যায়। তবে শিষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শিষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। আক্রান্ত শিষের দানা অপুষ্ট হয় ও কুঁচকে যায়। দানা ধূসর বর্ণের হয়ে যায়। গমের পাতায়ও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পাতায় চোখের মতো ধূসর বর্ণের ছোট ছোট দাগ পড়ে।

যশোর আঞ্চলিক কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬ সালে প্রথম দেখা দেওয়ার সময় গমের ব্লাস্ট রোগটি আমাদের দেশে ছিল একেবারেই নতুন। গমে এই রোগ দেখা দেওয়ার পর গবেষণা শুরু হয়। এরপর বারি গম-৩৩ নামে নতুন ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গমের ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী ডব্লিউএমআরআই গম-৩ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট দিনাজপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবদুল হাকিম বলেন, নতুন উদ্ভাবিত জাতটি জাতীয় বীজ বোর্ড ‘ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী’ জাত হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। এ বছর ভিত্তি বীজ উৎপাদনের জন্য বিএডিসিকে ব্রিডার সিড দেওয়া হবে।