বড় প্র্রতিষ্ঠানগুলো ফাঁদে পড়েছে

গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমিতে এই ভবনটির নির্মাণ অসমাপ্ত রেখেই এর প্রায় সব ফ্লোর বিক্রি করে চলে গেছে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান । ছবি: প্রথম আলো
গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমিতে এই ভবনটির নির্মাণ অসমাপ্ত রেখেই এর প্রায় সব ফ্লোর বিক্রি করে চলে গেছে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান । ছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। অর্থসংকটে জর্জরিত ট্রাস্টের নিজের কিছু করার সামর্থ্য নেই। শুরু থেকেই নেই দক্ষ জনবল।
গুলিস্তান কমপ্লেক্স নিয়ে ট্রাস্টের সঙ্গে ভবন নির্মাতাদের অসম চুক্তির নজির দ্বিতীয়টি নেই। গুলিস্তান ও নাজ সিনেমার জায়গায় স্থাপিত ২০ তলা ভবনের পুরোটাই বিক্রির সুযোগ পায় ভবন নির্মাতা। ভবনটির অর্ধেক পেলেও কল্যাণ ট্রাস্ট দেড় শ কোটি টাকা পেত।
১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে বিএনপি-সমর্থক ব্যবসায়ী এ এস এম আলাউদ্দিনের প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের সঙ্গে এ চুক্তি হয়। পরে বিএনপি সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদের সঙ্গে ওই ব্যবসায়ীর সখ্য থাকায় তিনি অনিয়ম করেও পার পান বলে অভিযোগ রয়েছে।
চুক্তির সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন খন্দকার আসাদুজ্জামান, যিনি সাবেক সচিব ও পরে সাংসদ নির্বাচিত হন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেন্ডার ডকুমেন্ট যেভাবে তৈরি হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে সর্বনিম্ন দরদাতা যে হয়েছে, সে-ই কাজ পেয়েছে। নিয়মের বাইরে অন্য কোনো পরিচয় দেখা হয়নি।’
রেদোয়ান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দায়িত্ব নিয়ে তিনি দেখতে পান খুবই বাজে একটি চুক্তি হয়েছে। এত বড় ভবনে চারটি লিফট থাকবে, প্রতি বর্গফুট তিন টাকা ভাড়া এবং মাত্র একটি ফ্লোর কল্যাণ ট্রাস্ট পাবে। এরপর চুক্তি সংশোধন করে ১৬টি লিফট, প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা এবং পাঁচটি ফ্লোর কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরে কী হয়েছে, তা তিনি জানেন না।
তবে কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্র জানায়, প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আলাউদ্দিন। গুলিস্তানের মতো এলাকায় কাজের শুরুতেই প্রায় সব স্পেস বিক্রি হয়ে যায়। তাই তাঁকে আলাদা বিনিয়োগ করতে হয়নি।
আলাউদ্দিনের সঙ্গে গতকাল যোগাযোগ করা যায়নি। আগে এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, কমপ্লেক্স থেকে সর্বসাকল্যে ৮০ থেকে ৮২ কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। খরচ হয়েছে তার চেয়ে বেশি। কল্যাণ ট্রাস্ট ও ব্যবসায়ী-ক্রেতাদের মতো তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার কথা জানিয়ে ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, কাজ শেষ না করেই ভবন বিক্রি করে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান চলে গেছে। এখন ট্রাস্ট পুরো ভাড়া পাচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১১ তলা পর্যন্ত সবকিছু ঠিক করা গেলে ট্রাস্টের পক্ষ থেকেই বাকি নয়তলা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
গুলিস্তান ও নাজ সিনেমা হল ছাড়াও ওই এলাকায় ছিল ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠান যাত্রিক পাবলিকেশনসের ছাপাখানা ও প্রকাশনা, গুলিস্তান ফিল্ম করপোরেশন, দুর্বার অ্যাডভার্টাইজিং, আনিস ফিল্মস ও মডার্ন ইলেকট্রনিকস।

মুন সিনেমা নিয়ে চার দশক:

পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাট এলাকার মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে একটি রিটের পর অনেক কিছুই ঘটে গেছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।
মামলায় জিতলেও জমি ফেরত পাননি মুন সিনেমা হলের মালিক মাকসুদুল আলম। ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘জমি বুঝিয়ে দেওয়ার মালিক পাওয়া যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশ আমরা মানতে চাই। কিন্তু কাকে ওই জমি বুঝিয়ে দেব?’
মাকসুদুল আলমের আইনজীবী এ বি এম ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, জমি বুঝিয়ে না দেওয়ায় আদালত অবমাননার অভিযোগ পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
২০১১ সালের ১১ মে আপিল বিভাগ মুন সিনেমা হলের জমির মালিককে জমি বুঝিয়ে দিতে বলেছিলেন।
মুন সিনেমা হলের জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৩৩৭৪ একর, সরকারি মূল্যতালিকা অনুযায়ী এর বাজারমূল্য চার কোটি ৪৭ লাখ টাকা, প্রকৃত মূল্য তার চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার পর এ সম্পত্তি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে তা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
গুলিস্তান কমপ্লেক্সের মতো সেখানেও অসম চুক্তিতে একজন ভবন নির্মাতাকে জমিটি দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান ভবন তৈরি করে পুরোটাই বিক্রি করবে। কিন্তু ট্রাস্টের সঙ্গে মাকসুদুল আলমের মামলা থাকায় ভবন নির্মাতা দোকান বিক্রি করেছেন, ভাড়াও নিচ্ছেন। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় নির্মাণকাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি।

তাবানী বন্ধ:

কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন বন্ধের প্রায় পাঁচ বছর পর কোকা-কোলা আটলান্টা সম্প্রতি তাবানী বেভারেজকে ১২৪ কোটি টাকা নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা ছিল এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে।
মিরপুরে যন্ত্রপাতিসহ সাত একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত বিশাল ওই কারখানা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ভেতরে লাখ লাখ খালি বোতল। যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরেছে।
গত রোববার শ্রমিক নূরুল ইসলাম গায়ের জামা তুলে দেখালেন, বোতল বিস্ফোরণে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে যাওয়ার চিহ্ন। বললেন, ‘এই কারখানার সঙ্গে মিশে আছে আমাদের ঘাম, শ্রম ও অস্তিত্ব।’
মাত্র সাত হাজার ৩০০ টাকা বেতন পান মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নুরুল ইসলাম। ১৯৮৬ সালে যোগ দেন, চাকরি স্থায়ী হয় ২০১০ সালে। বললেন, তাঁর মতো ২৩ জন এই বেতনে চাকরি করছেন।
শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি এম এইচ আলম জানান, ‘ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই ১২৪ কোটি টাকা যথেষ্ট নয়। কিন্তু আমরা জানতে চাই, এর মধ্যে শ্রমিক-কর্মচারীদের অংশ কত? তাঁরা কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন?’

জন্ম থেকেই বন্ধ রসের কারখানাটি:

চট্টগ্রামে কালুরঘাটে ৫ দশমিক ৬ একর জমির ওপর নির্মিত হয় ‘মাল্টিপল জুস কনসেনট্রেট প্ল্যান্ট (এমজেসিপি)’। এটি স্থাপনে ট্রাস্টের ব্যয় হয় ১৬ কোটি টাকা। ১৯৮৭ সালে উৎপাদনে যাওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ এর উদ্বোধন করেন।
কারখানার সঙ্গে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা জানান, সুইডিশ কোম্পানি প্রতি টন আনারস থেকে যে পরিমাণ জুস এবং প্রতি টন টমেটো থেকে যে পরিমাণ পেস্ট তৈরি হওয়ার কথা বলেছিল, বাস্তবে তা হয়নি। তা ছাড়া কারখানা চালু করতে যে পরিমাণ আনারস প্রয়োজন, তার জোগান ছিল না।
কারখানার ভেতরেই ছিল এক হাজার টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন হিমাগার। এটি ভাড়া দেওয়া হতো। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটিও নষ্ট হয়ে গেছে।

চিকিৎসা দিলেও বাঁচবে না ট্রাস্ট হাসপাতাল:

ঢাকা চিড়িয়াখানার কাছাকাছি মূল সড়কের পাশে ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালের মরিচা ধরা বড় সাইনবোর্ড দেখেছেন অনেকেই। কিন্তু ভেতরটি ধ্বংসস্তূপ।
হাসপাতালের বাইরে সাতটি গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। দুটির গায়ে লেখা, ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল। ফ্রান্স থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া বড় দুটি গাড়িতে অত্যাধুনিক এই হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল। বাকি পাঁচটি গাড়ির মধ্যে রয়েছে একটি বড় ট্রাকে স্থাপিত অ্যাম্বুলেন্স, একটি সাধারণ অ্যাম্বুলেন্স, দুটি কার এবং একটি অটোরিকশা।
হাসপাতালের ভেতরে দেখা গেল, মেডিসিন বিভাগ, স্ত্রীরোগ বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার, বিভিন্ন চিকিৎসকের পরিচয়-সংবলিত নামফলক। হাসপাতালের ওপরে গিয়ে দেখা যায়, পঞ্চম তলা ভেঙে চতুর্থ তলার সঙ্গে মিশে গেছে। সেখানে জন্মেছে গাছপালা।
হাসপাতালটি নির্মিত হয়েছিল ফ্রান্সের আর্থিক অনুদানে। নব্বই-পরবর্তী বিএনপি সরকার ইসলামী উম্মা নামের একটি জঙ্গি সংগঠনকে হাসপাতালটি ভাড়া দেয়। তারা হাসপাতালের সঙ্গে উম্মা মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলে। সংগঠনটির কর্মকাণ্ডে ট্রাস্টের সঙ্গে ইসলামী উম্মার মতবিরোধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে এটির নাম দেওয়া হয় সৈয়দ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ। ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়।

চট্টগ্রামের কালুরঘাটের এই ফলের রসের কারখানা ১৯৮৭ সালে উদ্বোধনের পর থেকেই বন্ধ রয়েছে । ছবি: জুয়েল শীল

মিরপুরে ট্রাস্ট হাসপাতালের পাশেই ১৩ একর জমি রয়েছে কল্যাণ ট্রাস্টের। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নাম দিয়ে এই বিশাল এলাকার দখল নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। গত রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, কমপ্লেক্স বলা হলেও কয়েক হাজার ছোট বস্তিঘর ও দোকান গড়ে তোলা হয়েছে ওই জায়গায়।
তেজগাঁওয়ের মেটাল প্যাকেজেস লিমিটেড সাবান তৈরির কাঁচামাল তৈরি করত। পরিত্যক্ত এই কারখানার দুই একর জমি এক ব্যক্তিকে ভাড়া দেওয়া হয়। তিনি ভাড়া না দিয়ে উল্টো মামলা করেছেন ট্রাস্টের বিরুদ্ধে।
গাজীপুরে ইউনাইটেড টোব্যাকো কোম্পানি ও বাংলাদেশ গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (হাইসন্স) পরিত্যক্ত হয়ে আছে।
তেজগাঁওয়ের সিরকো সোপ অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধ। হাজারীবাগে দুটি ট্যানারির জমি বিক্রি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে ৬০ হাজার বর্গফুট ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়্যারহাউসের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। সেখানে হামিদা মেটাল, হামিদা অয়েল কোম্পানি ও মদিনা ট্যানারি বিক্রি হয়ে গেছে। বাক্সলি পেইন্টের জায়গায় গুদাম নির্মাণকাজ চলছে। আলমাস ও দেরায়ার পিকচার্স সিনেমা হল লিজ দেওয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গাজী এ কে এম ওসমান গণি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা মারা যাওয়ার আগেই চোখের সামনে একে একে কারখানাগুলো বন্ধ হলো। বঙ্গবন্ধু যা দিয়েছিলেন, তার সুষ্ঠু ব্যবহার হলে এ দেশের প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই কোটিপতি থাকতেন।’
সংশোধনী: কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নামের সঙ্গে গতকাল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) পদবি উল্লেখ করা হয়, এটি হবে মেজর জেনারেল।