‘ভবঘুরের’ কাজ এটা নয়, ইকবালের পেছনে কারা: রানা দাশগুপ্ত

গভীর রাতে মসজিদ থেকে পবিত্র কোরআন নিয়ে যাচ্ছেন এই যুবক, তিনি ইকবাল হোসেন বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশসিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া ছবি

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার মূল পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামে নিজের বাসভবনে স্থানীয় সাংসদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে মতবিনিময় শেষে এ দাবি জানান রানা দাশগুপ্ত। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কুমিল্লার ঘটনায় ইকবাল হোসেন নামে যাঁকে গ্রেপ্তার বা চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁর নামের আগে একটা শব্দ জুড়ে দিল। সেটা হলো ভবঘুরে। কখনো কখনো এমন যাদের ধরা হয়, কখনো বলে পাগল, না হলে বলে ভবঘুরে।

পুলিশের এই বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে রানা দাশগুপ্ত বলেন, এই ভবঘুরে কী করে পবিত্র কোরআন শরিফ চিনল? যদি সে ভবঘুরে হয়ে থাকে, রাস্তার লোক হয়, তাহলে নতুন বই কোত্থেকে আনল, কে দিল? আর হনুমানের গদাটা এমনভাবে সরাল, যাতে হাতের কিছু না হয়, আবার সেখানে পবিত্র কোরআন শরিফ দিয়ে দিল—এটি কোনো ভবঘুরের কাজ হতে পারে না। এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। চক্রান্তকারীরা পেছনে আছে। তাদের বের করে আনার দায়িত্ব রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সরকারকে নিতে হবে।

শারদীয় দুর্গাপূজার মহা অষ্টমীর দিন গত ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘির উত্তর পাড়ে দর্পণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন দেখা যায়। এরপর কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই মণ্ডপে হামলা চালায় একদল লোক। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। এ ঘটনার জের ধরে ওই দিন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হিন্দুদের ওপর হামলা করতে যাওয়া একদল ব্যক্তির সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সেখানে নিহত হন চারজন। পরদিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপ ও দোকানপাটে হামলা–ভাঙচুর চালানো হয়। সেখানে হামলায় নিহত হন দুজন। এরপর রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু বসতিতে হামলা করে ভাঙচুর, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। দেশের আরও অনেক এলাকায় হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা করা হয়।

গতকাল বুধবার কুমিল্লা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইকবাল হোসেন (৩৫) নামে স্থানীয় এক যুবক গভীর রাতে মসজিদ থেকে পবিত্র কোরআন নিয়ে ওই পূজামণ্ডপে রেখেছিলেন। ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ইকবালের বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছে। ইকবাল হোসেনকে ভবঘুরে হিসেবে বর্ণনা করে পুলিশ বলেছে, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। বৃহস্পতিবার বেলা একটায় চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানজী পুকুরপাড়ায় রানা দাশগুপ্তের বাসায়
ছবি: সৌরভ দাশ

তবে আজ বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, নির্দেশনা পেয়ে কিংবা কারও প্ররোচনা ছাড়া ইকবাল হোসেন এটি করেছেন বলে তাঁরা মনে করেন না। তাঁকে ধরতে পারলে বাকি সব উদ্ধার হবে বলে তিনি মনে করছেন।

শিক্ষা উপমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী আমার এখানে এসেছেন। আলোচনার বিষয় ছিল, আমি তাঁর কাছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় যারা ক্ষুব্ধ, আমি তাদের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করেছি। আমরা দুজন মিলে করণীয় কী হওয়া উচিত, তা নিয়েও আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে, সম্প্রীতিতে, কীভাবে আমরা ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করতে পারব, সে বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমিও আমার কথা বলেছি।’

সাম্প্রতিক এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে ক্ষোভ ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘আমি এ কথাগুলো স্পষ্টভাবে বলেছি। মাঠে আমি যা বলেছি, সেগুলো উপমন্ত্রীকেও বলেছি। এই ক্ষোভ ও দূরত্ব যদি অব্যাহত থাকে, এটা কারও জন্য শুভ হবে না। দেশের জন্য তো নয়। অতএব করণীয় কী? রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল এবং সরকারকে আমি বলেছি, এটি পুনর্নির্ধারণ করা দরকার এবং আমাদের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, এই আলোচনাগুলো প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করার জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করেছি।’

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রীকে বলেছি, সর্বত্রই প্রশাসনের গাফিলতি আছে, রাজনৈতিক দলের গাফিলতি আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের পাশে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীকে দেখা যায়নি। সেখানে বলেছি, শুধু আমি যদি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব পুলিশের ওপর ছেড়ে দিই, সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধ করা—এটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি না তার হাতিয়ারের সঙ্গে জনগণ অবস্থান গ্রহণ না করে। এখন কীভাবে করবে, সেটা সরকার এবং রাজনৈতিক দলকেই নির্ধারণ করতে হবে। আমি আমার কথাগুলো বলেছি।’

রানা দাশগুপ্ত বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ ঘোষণার দ্রুত বাস্তবায়ন দাবিতে আগামী শনিবারের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সারা দেশে গণ–অনশন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য শিক্ষা উপমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি আমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করেছেন।

আলোচনার বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দীর্ঘক্ষণ আমার চাচা শ্রদ্ধেয় রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁর উদ্বেগ ও পর্যবেক্ষণগুলো আমি শুনেছি। তিনিও বলেছেন, আমিও বলেছি একটা বিষয়—শুধু প্রশাসন দিয়ে সর্বদা, সার্বক্ষণিক শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা খুবই কঠিন। এটাই হচ্ছে সারা পৃথিবীর বাস্তবতা, শুধু বাংলাদেশে তা-ই নয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা এখানে আলোচনায় এসেছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। বৃহস্পতিবার বেলা একটায় চট্টগ্রাম নগরেরর দেওয়ানজী পুকুরপাড়ায় রানা দাশগুপ্তের বাসায়
ছবি: সৌরভ দাশ

মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে সম্প্রীতি সমাবেশ ও মিছিল করার নির্দেশনা দিয়েছেন। দল ও অঙ্গসংগঠনগুলো মাঠে নেমেছে। আগামী দিনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার যে অঙ্গীকার ও প্রত্যয়, সেটা অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে।

আওয়ামী লীগ নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘শুধু চট্টগ্রাম নয়, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও রংপুরসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় অনেক ঘটনা ঘটেছে। সরকার সেগুলো নিয়ে শতভাগ তৎপর আছে। আমরা কোনোভাবেই বলতে পারব না যে এখানে কোনো ধরনের নির্লিপ্ততা আছে। এর আগের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেউ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাতে এমন মানসিকতা ধারণ না করেন যে এখানে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আমরা কিন্তু প্রতিহত করেছি এবং আগামী দিনেও করব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বত্র একটা শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংক্ষুব্ধ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, যে ঘটনা সংক্ষুব্ধ হবেন সেটাই স্বাভাবিক। সাম্প্রদায়িক শক্তি যে এ কাজটি করছে সেটাতে তো আমরাও সংক্ষুব্ধ। আমাদের দলও সংক্ষুব্ধ এবং সংক্ষুব্ধ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তার জন্যই আমরা সম্প্রীতি সমাবেশ করছি।’