ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়তি, ভরসা আমদানি

  • বাজারে মোটা চালের দাম ৪৮-৫০ টাকা, গত বছরের চেয়ে ৪৮% বেশি।

  • সরু চালের কেজি ৬০-৬৬ টাকা, গত বছরের চেয়ে বেশি ১৭%।

গত মে-জুনে চালের দাম বেড়ে যায়। এরপরে বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে হাওরে ফসল নষ্ট হওয়ায় চালের সংকট দেখা দেয়
ফাইল ছবি

চালের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম আমনের ধান উঠলে দামে লাগাম আসবে, এটাই ছিল আশা। কিন্তু দেখা গেল, দাম তো কমেইনি, উল্টো বাড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার চাল আমদানিতে বাড়তি জোর দিচ্ছে। গতকাল বুধবারই ভারতের সঙ্গে দেড় লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির চুক্তি হয়। আরও দেড় লাখ টন আমদানির বিষয়টি আগে থেকেই প্রক্রিয়াধীন ছিল, যার বড় অংশও ভারত থেকে আসছে। ভারতীয় চালের দাম পড়ছে প্রতি কেজি ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা।

সিদ্ধান্ত আসতে পারে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির শুল্ক কমানোর বিষয়ে। বর্তমানে চাল আমদানিতে মোট করভার ৫৫ শতাংশের মতো। ২০১৯ সালের মে মাসে চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক বাড়ানো হয়। এখন আবার কমানোর বিষয়টি ভাবছে সরকার।

সরকার আমদানি করে মজুত বাড়াবে। তবে সব মিলিয়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টনের বেশি আমদানি হবে না।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন,

সরকারিভাবে চাল আমদানিতে বাড়তি জোর দেওয়ার কারণ, খাদ্য অধিদপ্তরের গুদামে চালের মজুত গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। পরিমাণের দিক দিয়ে যা সাড়ে ৫ লাখ টন। ওদিকে চালকলমালিকেরা ৩৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে দাম প্রতি কেজি ৪১ টাকা না করলে নতুন আমন মৌসুমের চাল সরকারকে দিতে রাজি নন। ফলে আমদানি ছাড়া বিকল্পও নেই।

খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আমদানি করেই মজুত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতে চালের দাম সবচেয়ে কম। দেশটির সঙ্গে চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে না এলে বেসরকারি আমদানি উৎসাহিত করতে কর কমানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।

ঢাকার খুচরা বাজারে এখন মোটা গুটি ও স্বর্ণা চালের দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে। মাঝারি পাইজাম, বিআর-২৮সহ বিভিন্ন চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৮ টাকা কেজি। আর সরু মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল ৬০ থেকে ৬৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন মোটা চালের দাম প্রায় ৪৮ শতাংশ, মাঝারি ২৩ ও সরু চালের দাম ১৭ শতাংশ বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল পুরান ঢাকার বাবুবাজারের চালের আড়তে মোটা গুটি ও স্বর্ণা চাল প্রতি কেজি ৪৪ টাকার আশপাশে, মাঝারি চাল ৪৮-৫২ টাকা ও সরু চাল ৫৬ থেকে ৬৩ টাকা দরে বিক্রি হয়। কুষ্টিয়া ও নওগাঁ থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানান, সেখানেও চালের দাম বাড়তি।

সপ্তাহ দুয়েক আগে যখন আমনের চাল মোটামুটি ভালো পরিমাণে আসতে শুরু করে, তখন দাম বাড়ার প্রবণতা থেমে যায়। এরপর দেখা গেল, সরবরাহ আর বাড়ছে না। ফলে দাম বাড়তে শুরু করে।
কাওসার রহমান, বাবুবাজারের শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক

বাবুবাজারের শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক কাওসার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহ দুয়েক আগে যখন আমনের চাল মোটামুটি ভালো পরিমাণে আসতে শুরু করে, তখন দাম বাড়ার প্রবণতা থেমে যায়। এরপর দেখা গেল, সরবরাহ আর বাড়ছে না। ফলে দাম বাড়তে শুরু করে।

নানা রকমের চাল
ছবি: প্রথম আলো

দেশে বছরে সাড়ে ৩ কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো আসে আমনে। এ মৌসুমে খাদ্য মন্ত্রণালয় দেশের বাজার থেকে ২ লাখ টন ধান ও সাড়ে ৬ লাখ টন চাল কেনার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। গত ৭ নভেম্বর থেকে সংগ্রহ অভিযান শুরু করে গতকাল পর্যন্ত খাদ্য অধিদপ্তর চাল কিনতে পেরেছে ১৩ হাজার টনের মতো। গত বোরোতেও সরকার লক্ষ্য অনুযায়ী চাল সংগ্রহ করতে পারেনি।

চালকলমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম কমতে দেখছি না, বরং বাড়ছে। ফলে সরকার নির্ধারিত দামে বেশির ভাগ মিল চাল দিতে পারছে না।’

বাজারে দাম বাড়তে থাকলেও কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, চালের কোনো ঘাটতি নেই। মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, এবার আমনে লক্ষ্যের চেয়ে ১৫ লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হয়েছে। তারপরও আগামী জুন পর্যন্ত দেশে চাহিদার চেয়ে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।

বাজারে দাম বাড়তে থাকলেও কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, চালের কোনো ঘাটতি নেই। মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, এবার আমনে লক্ষ্যের চেয়ে ১৫ লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হয়েছে। তারপরও আগামী জুন পর্যন্ত দেশে চাহিদার চেয়ে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, আমনের এই ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই সরকার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ধানের ভালো দাম পেয়ে কৃষক লাভবান হয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আমদানি করে মজুত বাড়াবে। তবে সব মিলিয়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টনের বেশি আমদানি হবে না।

সাধারণত দেখা যায়, সরকারি গুদামে চালের মজুত কমলেই বাজারে দাম বাড়তে থাকে। এ বছর চালের দাম ২০১৭ সালের পর সবচেয়ে বেশি থাকলেও বাজারে খুব বেশি হস্তক্ষেপ করতে পারেনি সরকার। আবার শুল্ক কমিয়ে দিলে বিপুল চাল চলে আসে, যা ধানের দাম কমিয়ে কৃষককে বিপাকে ফেলে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান মনে করেন, আমদানির নামে যাতে বিপুল পরিমাণে চাল চলে না আসে, সেটি সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের দিকে ৬ লাখ টনের ঘাটতির কথা বলে দেশে প্রায় ৪০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছিল। প্রয়োজনের অতিরিক্ত চালের কারণে টানা তিন বছর কৃষক ধানের ভালো দাম পায়নি।