ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের কথাকার

শাহ আবদুল করিম

‘ব্যাটা, গান ছাড়বে না। সাধনা চালিয়ে যাও। একাগ্রতা থাকলে একদিন গণমানুষের শিল্পী হবে তুমি।’ এমনটা বলেছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ১৯৫৭ সালে, কাগমারি সম্মেলনে। যাঁর উদ্দেশে বলেছিলেন, তিনি চল্লিশ পেরোনো আবদুল করিম। তখনো তাঁর নামের আগে ‘শাহ’ শব্দটি যুক্ত হয়নি। তৎকালীন তুখোড় রাজনীতিক (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তরুণ করিম টাঙ্গাইলের সন্তোষে গিয়েছিলেন কাগমারি সম্মেলনে গাইতে। এক মঞ্চে কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবেশন করলেন গান। তারপরই মুগ্ধ ভাসানী করিমকে আশীর্বাদসূচক কথাগুলো বলেছিলেন।

শাহ আবদুল করিম এরপর আরও ৫২ বছর বেঁচে ছিলেন। তবে কখনো জীবন ও সংগীতে আপস করেননি। বিচ্যুত হননি সাধনার একাগ্রতা থেকে। ফলে ভাসানীর ভবিষ্যদ্বাণী শেষতক ফলল। ধীরে ধীরে করিম ঠিকই পরিণত হলেন গণমানুষের শিল্পীতে, কিংবদন্তিতেও।

১৯১৬ থেকে ২০০৯—তিরানব্বই বছরের জীবন ছিল তাঁর। যেখানে জন্মেছেন, সেটাও একেবারে অজপাড়াগাঁ, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের ধল গ্রাম। কালেভদ্রে গান গাইতে শহরে কিংবা দু-তিনবার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার বিষয়টা বাদ দিলে বলা যায় করিম আমৃত্যু গ্রামেই কাটিয়েছেন। কৈশোরে ছিলেন রাখালবালক, ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন বাউলগানের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী। প্রায় সাত দশক সংগীতরসিক গ্রামীণ মানুষের তীব্র ভালোবাসার ভাগ পেয়েছেন। জীবদ্দশায় শেষ দিকে এসে তাঁর গান আর সুরে মুগ্ধ শহুরে মানুষের উন্মাদনাও কিছুটা দেখে গেছেন তিনি। তবে করিম এসব খ্যাতি, সুনাম আর যশ থেকে সব সময়ই নিজেকে দূরেই রেখেছেন, হাজারো মানুষের ভিড়েও তিনি ছিলেন একেবারেই একা, যেন নির্জন পথের এক পথিক।

নির্লোভ, সততা ও একাগ্রতা শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে গেছে এক অন্য উচ্চতায়। লোকায়ত ধারার অন্য গীতিকবিদের চেয়ে তাঁর গানে বৈচিত্র্যের মাত্রা বেশি। একেবারেই সাদাসিধে, কিন্তু অনন্য এক মোহাবিষ্ট মেজাজ এই শিল্পীর গানকে দিয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। আবার তর্কবিতর্কমূলক মালজোড়া গানেরও একজন বিশিষ্ট শিল্পী ছিলেন তিনি। এমনকি লালন-পরবর্তী সময়ে বাউলগানের গীতিকার হিসেবে করিমই এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত। অথচ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঝুলিতে জমা রয়েছে কেবল আট দিনের অক্ষরজ্ঞান। নিছক ‘অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন’ হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতি, সমাজ ও জগৎ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা কাজে লাগিয়ে পরিণত হয়েছিলেন দার্শনিক ও শিক্ষিত ব্যক্তিতে। বিশ শতকের গ্রামীণ এই মনীষী ভাবনা ও চেতনার ক্ষেত্রে কতটা প্রাগ্রসর ছিলেন, তা তাঁর প্রায় ৫০০ গানের সংকলন শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র (২০০৯) পাঠেই বোঝা যায়।

জীবন ও গানের মধ্য দিয়ে ধল গ্রামের শাহ আবদুল করিম এখন কেবল তাঁর গ্রামেরই নন, হয়ে উঠেছেন সারা বাংলার।

দুই.

বাউলসাধনা, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, ভক্তিগীতি ও বিচ্ছেদ শাহ আবদুল করিমের রচনার বিষয়বস্তু। গুহ্য সাধনপথের সাধক হয়েও করিম প্রগতি, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তচেতনার পাশাপাশি আগাগোড়াই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের গল্প বলতে চেয়েছেন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, করিম তাঁর অঞ্চলের মানুষের সুখ–দুঃখ, দুর্দশা–হতাশার বাস্তব ও নির্মম গল্পগুলোই গ্রথিত করে গেছেন গণসংগীতসহ নানা পর্যায়ের গান রচনার মাধ্যমে। যে জনপদে তাঁর জন্ম হয়েছিল, এর আশপাশের সাত জেলাজুড়ে বিস্তৃত রয়েছে হাওর, যা আবার ছয় মাস থাকে পুরোপুরি পানির নিচে, আর বাকি ছয় মাস একেবারেই শুষ্ক। সে রকমই এক ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে করিম তাঁর দেখা জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন এবং বেদনার চিত্রগুলোকে নিজের গানে উপকরণ হিসেবে ধার নিয়েছেন। এই ‘ধার করা’ উপকরণের সমষ্টিগত যে প্রকাশ, সেটি পৃথক ও স্বতন্ত্র হিসেবেই করিম-রচনায় স্থান পেয়েছে।

প্রসঙ্গক্রমে শাহ আবদুল করিমের একটি সাক্ষাৎকার স্মর্তব্য। ১৯৯৭ সালে টি এম আহমেদ কায়সারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘লোকে কয়, আমি নিরন্ন দুস্থ মানুষের কবি, আমি আসলে তাক ধরে দুস্থদের জন্যে কিছু লিখিনি। আমি শুধু নিজের কথা বলে যাই, ভাটি অঞ্চলের একজন বঞ্চিত–নিঃস্ব–দুঃখী মানুষ আমি, আমার কথা সব হাভাতে মানুষের কথা হয়ে যায়। [...]। এই মানুষগুলোর সুখ যারা কেড়ে নিয়েছে, আমার লড়াই তাদের বিরুদ্ধে। একদা তত্ত্বের সাধনা করতাম, এখন দেখি তত্ত্ব নয়, নিঃস্ব–বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব আর সোনার বাংলা, সোনার মানুষ বললে হবে না। লোভী, শোষক, পাপাত্মাদের আঘাত করতে হবে।’ তার মানে, করিম নিজে ‘বঞ্চিত–নিঃস্ব–দুঃখী মানুষ’ হিসেবে যে অভিজ্ঞতা, বঞ্চনা ও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেসবই তাঁর রচনায় নিবিষ্টতার সঙ্গে স্থান দিয়েছেন।

প্রায় গানেই ছিল ব্যক্তি করিমের সামষ্টিক উচ্চারণ, অনেকটা এমনই, ‘গরিব বাঁচবে কেমন করে কার কাছে তা জিজ্ঞেস করি/ গরিবের বাঁচার সম্বল নাই ধনীরা স্বার্থের পূজারি॥’ কেবল প্রশ্ন উত্থাপন করেই করিম থেমে যাননি, বরং তার সমাধানও দিয়েছেন, ‘গরিব কাঙাল কৃষক মজুর এক যদি সব হতে পারি/ বাউল আবদুল করিম বলে দুঃখের সাগর দিব পাড়ি॥’ একটু আগে, সাক্ষাৎকারেও করিমের প্রতিবাদী উচ্চারণ পেয়েছি আমরা; তিনি সেখানে সমাজের ‘লোভী, শোষক, পাপাত্মাদের আঘাত’ করার হুমকি ছুঁড়েছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে করিম সম্পর্কে সাহিত্যিক যতীন সরকারের বক্তব্য একেবারেই প্রণিধানযোগ্য, ‘দুঃখ নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ তাঁর অন্তরে আছে বলেই দুঃখের কারণের তিনি সন্ধান করেন; আর দুঃখ-নিরোধের সম্ভাবনার ওপর বিশ্বাস আছে বলেই দুঃখ-নিরোধের পথ তথা “বাঁচার উপায়” তিনি খুঁজে ফেরেন জীবনভর।’ এই ‘দুঃখ-নিরোধের’ পথ খুঁজতে গিয়ে করিম কখনো কখনো প্রতিবাদী সত্তা ও আচরণের প্রকাশও ঘটিয়েছিলেন। এ কারণেই তো তাঁকে গান গাওয়ার পাশাপাশি দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, কাগমারি সম্মেলন, উনসত্তরের গণ–অভুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামেও সামনের সারিতে থাকতে দেখা গেছে।

শাহ আবদুল করিম বরাবরই তাঁর গানে মানুষ-ভজনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিয়েছেন। গানে তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ যদি হইতে চাও করো মানুষের ভজনা/ সবার উপরে মানুষ সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা॥/[...]/আবদুল করিম বলে হুঁশে থাকো মানুষ ভালোবাসতে শিখো/ অন্তরে অন্তরে মাখো রবে না ভবযন্ত্রণা॥’ এই মৃত্যুশাসিত সমাজে করিম প্রদত্ত এই ভালোবাসার পাঠ সমগ্র মানবজাতির কাছে অথৈ প্রেমের এক বার্তা হিসেবেই ধরা দেবে। জীবনের শুরু ও মাঝ বয়সে এসে যে করিম তত্ত্ব ও সাধনকেন্দ্রিক বাউলপন্থায় মনোনিবেশ করেছিলেন, সেই তিনি মানুষকেই ভালোবেসে বাউলতত্ত্ব ও সাধনচর্চার পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষের মুক্তির পথের সন্ধানে রত ছিলেন তিনি। তাই তো সাইমন জাকারিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার মন প্রথম থেকে বলেছিল যে সাধকেরা এটা এড়ায়ে যাবে কেন? মানুষ হইলে মানুষের খবরাখবর জেনে নিতে হবে। [...]। মানুষ মানুষের কাছেই তো কিছু আশা করে। সেই মানুষের খবর জানতে হবে। এটা শুধু আমার কথা না, এটা আমার ওপরে যাঁরা আছেন গণ্যমান্য, তাঁরাও এমন কথা বলেন।’ আর সে কারণেই করিম বাউল-দর্শন পরম্পরার উত্তরসূরি হয়েও তাঁর গানে মানুষে-মানুষে ‘মিলমিশ’ তৈরির আশায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছিলেন এবং গানে গানে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মানবপ্রেমের নিজস্বতা।

তিন.

বাংলার নিজস্ব লোকায়ত দর্শন আর মরমিচেতনাকে শাহ আবদুল করিম তাঁর চিন্তা-চেতনার মাধ্যমে করেছেন সমৃদ্ধ। ভেতরের সত্তাকে জানার ব্যাকুলতা প্রকাশ পায় তাঁর গানগুলোতে। এমনকি ‘কালির লেখায় আলিম হয় না’ জানিয়ে তিনি দেহের ‘অজানাকে’ জানার আহ্বানও জানান। ‘হৃদবাসরে’ যে ‘মনমানুষ’ বিরাজ করে তাঁকে পেতে হলে সাধনার প্রয়োজন, সেটাও জানান তিনি। বাঙালির উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব বিকাশে করিমের রচনা এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

শাহ আবদুল করিমের জন্মেরও বহু বহু আগে উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতার দর্শন আওড়িয়েছেন এই বাংলার দার্শনিক ও গ্রামীণ মনীষীরা। কিন্তু করিম যেভাবে গ্রামীণ বাংলার বৃহত্তর সমাজ ও মানুষের উপযোগী করে একেবারেই সাদাসিধে আটপৌরে ভাষায় গান রচনা করেছেন, আঙ্গিক ও উপস্থাপনের বিচারে সেটা তাঁর আগে খুব কমসংখ্যক সাধকেরাই করতে পেরেছিলেন। এ কারণেই করিম এখন এতটা নমস্য এবং সর্বজনবিদিত।

সুমনকুমার দাশ সাংবাদিক; লোক–সংস্কৃতির গবেষক