ভাগ্যের খোঁজে গিয়ে জীবনের ক্ষয়

  • গত বছরের প্রথম ১০ মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরেন ১ হাজার ৯৯১ জন।

  • চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ফিরেছেন ২৮ হাজার ৫২২ জন।

  • মানসিক অসুস্থতা নিয়ে ১০ নারী গৃহকর্মী ফিরেছেন এক মাসে।

দুই সন্তান রেখে স্বামী তালাক দিয়েছেন। ঝিনাইদহের রহিমা বেগম (ছদ্মনাম) অভাব ঘোচাতে ভাগ্যের খোঁজে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে জর্ডানে যান। সেখানে গিয়ে পড়েন ‘সাপ্লাই এজেন্টের’ খপ্পরে। যৌনবৃত্তির কাজে জোর করা হয় তাঁকে। রাজি না হলে মারধর। এরপর একপর্যায়ে বাসায় কাজে পাঠানো হয়। মাসভর কাজ করলেও বেতন চলে যেত এজেন্টের কাছে। আয়হীন কাজে নিয়মিত নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি দূতাবাসে সাহায্য চেয়ে ফোন করেন। মাথায় আঘাত নিয়ে গত ১০ সেপ্টেম্বর জর্ডান থেকে দেশে ফিরেছেন তিনি। অভাব এখন আগের চেয়ে তীব্রতর হয়েছে। থাকার জায়গাও নেই তাঁর। স্থানীয় এক সাংবাদিক ছাপরা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নির্যাতনের ক্ষত, সামাজিক চাপ সয়ে নিদারুণ জীবন সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর চেয়ে মৃত্যু ভালো।’

রহিমার মতো নির্যাতনের এ রকম ক্ষত নিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসছেন আরও অনেকে। চাপে, নির্যাতনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়েছেন অনেকে।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সূত্র জানায়, গত বছরের প্রথম ১০ মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে ১ হাজার ৯৯১ জন নারী ফিরে এসেছেন নিঃস্ব হাতে। এবার অক্টোবর পর্যন্ত ফিরেছেন ২৮ হাজার ৫২২ জন। নির্যাতিত হয়ে, মানসিক অসুস্থতা নিয়ে, করোনার প্রভাবে কাজ হারিয়ে ফিরছেন নারীরা। দেশে ফিরেও আয়হীন অসহায় জীবন যাপন করছেন তাঁরা। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ ফিরেছেন চুক্তির মেয়াদ শেষ করে।

করোনার প্রভাব সব দেশেই পড়েছে। বকেয়া বেতন বা নিপীড়িত কর্মীকে উদ্ধার করতে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের শ্রম বিভাগ নিয়মিত কাজ করছে। যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁদের পুনরেকত্রীকরণে ঋণ, প্রশিক্ষণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর যাঁরা আবার বিদেশ যেতে চাইবেন, তাঁদেরও সহায়তা করা হবে
মো. শামছুল আলম, বিএমইটির মহাপরিচালক

সৌদি আরব থেকে নারীদের ফেরা নিয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, যাঁরা কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যান বা অবৈধ হয়ে পড়েন, তাঁদের উদ্ধার করে বিভিন্ন বহির্গমন শিবিরে রাখে সৌদি পুলিশ। তাঁদের পাসপোর্ট না থাকায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) দিয়ে দেশে পাঠানো হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে আউটপাস নিয়ে ফিরেছেন ৬৯৫ জন নারী। এরপর গত এপ্রিল থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত নানা কারণে দেশে ফিরে এসেছেন ২৭ হাজার ৮২৭ নারী। প্রতিদিনই ফিরে আসছেন প্রবাসী কর্মীরা। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন ১৩ হাজার ২৭০ জন। এরপর আরব আমিরাত থেকে ৬ হাজার ২১৪ জন, কাতার থেকে ২ হাজার ৮৩৩, লেবানন থেকে ২ হাজার ৪৫৩ ও ওমান থেকে ফিরেছেন ২ হাজার ১৪৭ জন নারী কর্মী।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কর্মকর্তারা বলছেন, ৫ বছর ধরে প্রতি বছর এক লাখের বেশি নারী কর্মী বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কর্মী যান সৌদি আরবে। নারী কর্মীর ওপর নিপীড়ন কমাতে দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা চলছে। লাখো কর্মীর মধ্যে কিছু কর্মী ফিরে এসে অভিযোগ করেন। এ বছর করোনা মহামারির কারণে ফিরে আসাটা বাড়ছে। তবে এর মধ্যে একটি অংশ কাজ না থাকায় বেকার হয়ে এবং চুক্তি শেষ করে ফিরছে।

এ বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রভাব সব দেশেই পড়েছে। বকেয়া বেতন বা নিপীড়িত কর্মীকে উদ্ধার করতে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের শ্রম বিভাগ নিয়মিত কাজ করছে। যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁদের পুনরেকত্রীকরণে ঋণ, প্রশিক্ষণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর যাঁরা আবার বিদেশ যেতে চাইবেন, তাঁদেরও সহায়তা করা হবে।

আগের বছরের তুলনায় প্রবাসী নারীর ফেরা বেড়েছে ১৪ গুণ। নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে ফিরছেন নারীরা।

অনেকে ফিরছেন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে

ময়মনসিংহের ফরিদা খাতুন সৌদি আরব থেকে এক বছর পর দেশে ফেরেন আগস্টের শেষে। এক বছরে দেশে কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি বলে জানান তাঁর স্বামী রইসউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকর্তার অত্যাচার, নিপীড়নের কথা জানাতেন মাঝেমধ্যে। হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যান। দেশে ফেরার পর জানতে পারেন, মানসিক অসুস্থতা নিয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি অবস্থায় উদ্ধার করে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে সৌদি পুলিশ।

আর জর্ডান থেকে অসুস্থ হয়ে দুই বছর পর ফিরেছেন পাবনার আম্বিয়া খাতুন। তাঁর ছোট ভাই বিল্লাল হোসেন জানান, ফোনে ভয়, আতঙ্কের কথা বলতেন। এরপর টানা কয়েক মাস কোনো খবর পাননি। দেশে ফেরার পর মানসিক অসুস্থতার কথা জানতে পারেন।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি বলছে, মানসিক অসুস্থ হয়ে গত এক মাসে ফিরেছেন ১১ কর্মী, তাঁদের মধ্যে ১০ জন নারী গৃহকর্মী। গত দুই বছরে মানসিক অসুস্থ হয়ে দেশে ফেরা ৬৩ কর্মীকে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ৫৮ জন নারী কর্মী।

সৌদিতে নির্যাতনের সংখ্যা কমছেই না। দুই দেশের শ্রম আইনেও নারীর সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি।
ফরিদা ইয়াসমিন, পরিচালক, বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন

নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি

বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বমসা) বলছে, যাঁরা বাসায় থেকে কাজ করেন, তাঁদের ওপর করোনাকালে কাজের চাপ ও নির্যাতন বেড়েছে। অনেক নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। কাউকে কাউকে বাসায় বন্দী করে রাখা হয়েছে, খাবারও দেওয়া হয়নি নিয়মিত। তাই পালিয়ে হলেও তাঁরা ফিরে আসছেন। আর যাঁরা হোস্টেল বা মেসবাড়িতে থেকে কাজ করেন, তাঁরা করোনার শুরুতেই কাজ হারিয়েছেন। তাই এ বছর ফিরে আসার সংখ্যা বেড়ে গেছে।

এ বিষয়ে বমসার পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, সৌদিতে নির্যাতনের সংখ্যা কমছেই না। দুই দেশের শ্রম আইনেও নারীর সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। বাসায় থাকলে কর্মী নির্যাতিত হবেই। আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে চুক্তি করে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আর নারী কর্মী ও পরিবারের সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে বয়স বাড়িয়ে না যান।