বিরোধপূর্ণ এলাকা ২৫,৬০২ বর্গকিলোমিটার
বাংলাদেশ পেল ১৯,৪৬৭ বর্গকিলোমিটার, ভারত পেল ৬,১৩৫ বর্গকিলোমিটার

মিয়ানমারের পর এবার ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলো। নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশ পেয়েছে। বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে ভারত।
বাংলাদেশ এ রায়কে বিজয় হিসেবেই দেখছে। ভারত আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের হেগের সালিসি আদালত গত সোমবার এই রায় দেন। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে রায়ের বিস্তারিত জানায়।
এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, এই রায় উভয় রাষ্ট্রের জন্য বিজয় নিশ্চিত করেছে। এই বিজয় বন্ধুত্বের বিজয়। এই বিজয় বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের বিজয়। কেননা, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা, যা উভয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তা আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হলো। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনগত প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিনের বিরাজমান এই সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে ভারতের সদিচ্ছা এবং ট্রাইব্যুনালের রায় মেনে নেওয়ার জন্য আমরা ভারত সরকারকে সাধুবাদ জানাই।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপান অঞ্চলে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছে।
ভারত সমদূরবর্তী পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি করেছিল, আর বাংলাদেশ চেয়েছিল ন্যায্যতার ভিত্তিতে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এই আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, সমদূরবর্তী পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হলে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী তা ন্যায্যতা নিশ্চিত করে না।
এই রায়ের ফলে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি সুরাহা হওয়ায় বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানান, এই রায়ের ফলে বিরোধপূর্ণ সমুদ্র এলাকার বিপুল অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের আর কোনো বাধা থাকল না। এ রায়ে গভীর সমুদ্রে প্রস্তাবিত ১০টি তেল-গ্যাস ব্লকই পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়।
তবে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের যে জায়গাটিতে ছিল, তা ভারতের সীমানায় পড়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।
এই সালিসি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই। তবে ওই আদালতের পাঁচ বিচারকের অন্যতম ভারতের প্রেমারাজু শ্রীনিবাসা রাও কয়েকটি বিষয়ে ভারতের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে অন্য বিচারকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দীন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ভারত এ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়ের সুরাহা হওয়ায় দুই দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সদিচ্ছা আরও জোরদার হবে। তিনি বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হবে। আর এ উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে দুই দেশের জনগণ।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনার পর মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর সালিসি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ জার্মানির হামবুর্গভিত্তিক সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) মামলা দায়ের করেছিল। আর ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের মামলা দায়ের হয়েছিল হেগের স্থায়ী সালিসি আদালতে। ভারত ও মিয়ানমার সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা দাবি করায় বাংলাদেশের সাগর এলাকা মাত্র ১৩০ নটিক্যাল মাইলে সীমিত হয়ে পড়েছিল।
২০১২ সালের ১৪ মার্চ ইটলসে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী ন্যায্যতার ভিত্তিতে রায় দেওয়ায় ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক এলাকা এবং তদূর্ধ্ব মহীসোপান এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের সঙ্গে মামলায় হেগের আদালতেও এই সীমানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
হেগের আদালতে ২০১৩ সালের ৯ থেকে ১৮ ডিসেম্বর সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পক্ষে বাংলাদেশ ও ভারত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। শুনানিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম।
শুনানিতে বাংলাদেশের পক্ষে কৌঁসুলি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পল রাইখলার ও লরেন্স মার্টিন, যুক্তরাজ্যের জেমস ক্রাফোর্ড, ফিলিপ স্যান্ডস ও অ্যালান বয়েল এবং কানাডার পায়াম আখাভান।
সালিসি ট্রাইব্যুনালের বিচারক ছিলেন জার্মানির রুডিগার উলফ্রাম, ফ্রান্সের জ্যঁ-পিয়েরে কত, ঘানার টমাস এ মেনশাহ, অস্ট্রেলিয়ার ইভান শিয়ারার ও ভারতের প্রেমারাজু শ্রীনিবাসা রাও।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব মুস্তাফা কামাল প্রমুখ।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘আজ আমাদের আনন্দের দিন। ন্যায্যতার জয় হয়েছে। সকল পক্ষের জয় হয়েছে। আমাদের যা দরকার আমরা তা পেয়েছি। প্রতিবেশী দেশও তাদের যা পাওয়ার তা পেয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে খুরশেদ আলম জানান, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ১৮০ ডিগ্রি রেখা টানার পরিবর্তে ১৭৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি রেখা টানার পক্ষে রায়টি ভারতের জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে না, এই যুক্তি দেখিয়ে অন্য বিচারকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন ভারতীয় বিচারক প্রেমারাজু শ্রীনিবাসা রাও। তবে যেহেতু মামলার রায়টি ৪-১ ভোটে পাস হয়েছে, সেহেতু তাঁর আপত্তি কোনো প্রভাব ফেলবে না।