আমরা কি তাঁদের মনে রেখেছি?

ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র তখন চকবাজার। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন ছুঁয়ে গেছে মহল্লার সরদারবাড়ি থেকে গদিঘর পর্যন্ত। চায়ের কেটলিতে ফুটছে লিকার। উত্তেজিত তরুণসমাজ। ফেব্রুয়ারির শীতল বাতাসে মিছিলের উত্তাপ। প্রবীণদের অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত, তবে তরুণেরা চিরকালের নিঃসংশয়।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। আমাদের দাবি মানতে হবে’। স্লোগান ভেসে আসে মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাদ থেকে। তখন পুরান ঢাকার নামী স্কুল হিসেবে পরিচিত নাজিমুদ্দিন রোডের এই স্কুলটি। ঢাকার বনেদি পরিবারের মেয়েরা প্রধানত এই স্কুলে পড়ত। সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কখনো থেমে থেমে, কখনো একটানা স্লোগান চলতে থাকে।

ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা কারাগারে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভেতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল তার নাম ৪ নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেয়ালের বাইরে মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল ১০টায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”। “বন্দী ভাইদের মুক্তি চাই”। “পুলিশি জুলুম চলবে না”। নানা ধরনের স্লোগান দিত। এই সময়ে শামসুল হক সাহেবকে (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক) আমি ডেকে বল্লাম, “হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে, আর বাংলা রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।”’

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন ওই ছাত্রীদের অনেকে। ভাষা আন্দোলনের তখনকার সামনের সারির কর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ড. শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুরের ওপর দায়িত্ব ছিল ওই ছাত্রীদের সংগঠিত করে সমাবেশে নিয়ে যাওয়ার।

কী ছিল ওই ছাত্রীদের নাম-পরিচয়, জানতে চেয়েছিলাম পুরান ঢাকার চকবাজারের আদি বাসিন্দা এবং ভাষা আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন আহাম্মদের কাছে। গত শুক্রবার টেলিফোনে তিনি বলেন, সবার নাম পাওয়া যায় না। তবে কয়েকটা নাম পাওয়া যায়, যাঁদের বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জোহরা বেগম, হুরবানু, সালমা বেগম, মেহেরুন্নেসা, রোকাইয়া খাতুন, সালসাবিল হেনা। ছোট্ট এই ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে যোগ দেন এবং সবার সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে অংশ নেন। এর মধ্যে একজন-দুজন ছিলেন তাঁর আত্মীয়। তিনি বলেন, ‘হুর বানু আপার কাছে জেনেছি যে তিনি ও তাঁর বান্ধবীরা এই দুঃসাহসী কাজে নিবেদিত হয়েছিলেন আনন্দচিত্তে।’

মোমতাজ উদ্দিন আহাম্মদের মতে, পুরান ঢাকার তখনকার সমাজ ছিল নানা বিধিনিষেধের জালে বন্দী। সেই সময়ের কথা তুলনা করলে স্কুলের মেয়েদের বাংলা ভাষা ও রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য এ রকম স্লোগান দেওয়া, তাঁদের আপ্যায়ন করা ছিল বিরাট ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে ওই নারীরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন।

মেহেরুন্নেসা।
ছবি: সংগৃহীত

ভাষা আন্দোলনে নারীর অবদান নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা কম হয়েছে বলা যাবে না। উর্দুপ্রধান পুরান ঢাকা কীভাবে ভাষা আন্দোলনে শরিক হলো, তা-ও আমরা অনেকেই জানি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণায় সচেতন মহলে দপ করে জ্বলে ওঠে ক্ষোভের আগুন। আজিমপুর নিবাসী অধ্যাপক আবুল কাসেম এই ক্ষোভের পটভূমিকায় গঠন করেন তমুদ্দিন মজলিশ। এ সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। তখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল ঢাকাবাসী। তা কাটানোর জন্য আবুল কাসেম গঠন করেন ঢাকা মজলিশ নামে আরেকটি সংগঠন। এর দায়িত্ব অর্পণ করেন আবদুল মান্নানের কাছে, যিনি পরে নবকুমার ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম ধর্মঘট পালন করা হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ঢাকা শহরে এই যুগান্তকারী কর্মসূচি সফলে আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুনের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি (জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ)। ঢাকার মেয়ে হওয়ার কারণে স্থানীয় সরদার ও তরুণদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ও প্রভাব ছিল। তা ছাড়া পুরান ঢাকায় (খাজা দেওয়ান ১ম লেন) বসবাসের কারণে ও আত্মীয়তার সূত্রেও তিনি স্থানীয় নারীদের প্রভাবিত করেছিলেন। সে সময় তিনি মেয়েদের রাজপথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন (ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী নারী, ওবায়দুল্লাহ মামুন)।

পরবর্তী সময়ে পুরান ঢাকার মানুষের মনে বাংলা ভাষার প্রতি টান তৈরি করেন লজিং মাস্টাররা। বিভিন্ন বইপত্র থেকে পাওয়া যায়, এই লজিং মাস্টাররা ছিলেন খুব আদরের, পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তানের মতো। মুরগির ঠ্যাংটা, মাছের পেটিটা তাঁদের জন্য তুলে রাখতেন মা-জননীরা। তাঁরা বলতেন, ‘স্যার, আমার পোলা-মাইয়ারে পিটায়া মানুষ করতে আপনার ওপর ছাইরা দিলাম। অহন চামড়া আপনার, আর আমার লাইগা হাড্ডি রাখলেই চলব।’ ধারণা করা হয়, এই লজিং মাস্টাররাই প্রভাবিত করেছিলেন স্কুলের ছেলেমেয়েদের। এর সঙ্গে ঢাকার সরদারদের নেতা কাদের সরদার যখন ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাঁর অবস্থান প্রকাশ করেন, তখন পুরান ঢাকাবাসীর সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ আরও বেড়ে যায়।

লক্ষণীয় হলো, ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হলেও সেখানকার নারীদের অবদানের কথা বিভিন্ন আলোচনায় এখন পর্যন্ত কমই এসেছে। এ বিষয়ে লেখালেখি, গবেষণা অনেক কম।

ভাষা আন্দোলনের গবেষক এম আর মাহবুবের লেখা ‘আজিমপুরের ভাষা আন্দোলন’ বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘একুশের হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম পুরান ঢাকার আজিমপুর কলোনিতে মেয়েদের প্রথম প্রতিবাদ সভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সভায় সারা শহর থেকে শত শত মহিলা অংশগ্রহণ করেছিলেন।’

মুসলিম গার্লস স্কুলের সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে হুরবানু এখনো বেঁচে আছেন।
ছবি: সংগৃহীত

মুসলিম গার্লস স্কুলের সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে হুরবানু এখনো বেঁচে আছেন। মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন তিনি। তবে তিনি এখন কোথায় আছেন, তা জানা যায় না। সালমা বেগম ছিলেন আজিমপুর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মেহেরুন্নেসা, রোকাইয়া খাতুন, সালসাবিল হেনা—সবারই জীবনাবসান ঘটেছে নীরবে।

ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার নারী সমাজের অবদানের কথা ভুলে থাকা আমাদের ‘আজন্ম পাপ’। দিন গত হয়েছে অনেক, তবু তৈরি হোক প্রায়শ্চিত্তের পথ। কালো কালির অক্ষরে ভরে উঠুক পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তৃপ্ত হোক আত্মা।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো