ভাস্কর্যে স্বাধীনতা, অযত্ন, অবহেলায় শ্রীহীন

স্বাধীনতাযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে রাজধানী ঢাকায় গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু ভাস্কর্য। বিভিন্ন দিবস এলে এগুলো তাৎক্ষণিক পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু সারা বছর তদারকির অভাবে থাকে জীর্ণ, মলিন।
এসব ভাস্কর্যে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালির প্রতিবাদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা, গতি, উদ্যম, বীরত্ব, গণহত্যাসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের নানা স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্যগুলো।
মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অসামান্য আত্মত্যাগের স্মরণে নির্মিত প্রথম ভাস্কর্যটি অবশ্য রাজধানীর বাইরে অবস্থিত। গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর চৌরাস্তার ঠিক মাঝে সড়কদ্বীপে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ ভাস্কর্যটি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা হয়।
তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। তারই প্রতীক এই অপরাজেয় বাংলা। এর ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরতে দর্শনার্থীদের আগ্রহের মূলে থাকে এই ভাস্কর্য। এটি এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন ছাত্র এবং গণ-আন্দোলনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে। শুক্রবার বিকেলে দুই সন্তানকে নিয়ে অপরাজেয় বাংলার বেদিতে বসে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিটি ভাস্কর্যে এর নির্মাণ প্রেক্ষাপট, ভাস্কর এবং অন্যান্য তথ্য লেখা থাকলে আরও ভালো হতো। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বলে এগুলোর অবস্থা ভালো, বাইরেরগুলোর অবস্থা এতটা ভালো না।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামফলকসহ নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্মারক। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এই ‘স্মৃতি চিরন্তন’-এর অবস্থান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বললেন, সর্বশেষ ২০১৫ সালে সংস্কার করা হয় স্মৃতিস্মারকটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সড়কদ্বীপে ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’, উদয়ন স্কুল ও সলিমুল্লাহ হলের মাঝখানে অবস্থিত ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ ও ‘একাত্তরের গণহত্যা’ ভাস্কর্যগুলো একাত্তরের বীরত্বগাথা তুলে ধরছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
গুলিস্তানে ওসমানী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের নামে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ভাস্কর্য। দেশের মানচিত্রসহ প্রতিটি ভাস্কর্যে রয়েছে বিভিন্ন সেক্টরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এগুলো দেখে যে কেউ মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর সম্পর্কে সহজেই ধারণা পেতে পারে। কিন্তু এ ভাস্কর্যগুলো দিন দিন শ্রী হারাচ্ছে। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)।
গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, দিনে ভাস্কর্যগুলো ভাসমান মানুষের বিশ্রাম স্থান এবং নিরাপদ মাদক সেবনের আশ্রয়। ভাস্কর্যগুলো চুনকাম ও পরিষ্কার শেষ কবে হয়েছে দেখে বোঝার উপায় নেই।
কিন্তু ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এম কে বখতিয়ার দাবি করলেন, সারা বছরই ভাস্কর্যগুলো পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ দিবস উপলক্ষে আলাদাভাবে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম নেওয়া হয়। এবারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষেও ভাস্কর্যগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে।
বিজয় সরণি মোড়ে ‘মুক্তি চাই স্বাধীনতা চাই’ ভাস্কর্যটির অবস্থান। মুক্তিকামী মানুষের মিছিলকে মোজাইকের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে এই ভাস্কর্যে তুলে ধরা হয়েছে। পরে এই ভাস্কর্যের চারপাশে লাল সিরামিকের সীমানা, পানির ফোয়ারা, আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়।
গত শুক্রবার গিয়ে দেখা যায়, ভাস্কর্যটি ঢাকা পড়েছে রাজনৈতিক পোস্টারে। ভাস্কর্যের এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা রাখেননি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। ভাস্কর্যের সামনের লাল সিরামিক ভেঙে পড়ে আছে। ভাস্কর্যের নিচের অংশে জমা নোংরা পানি ও ময়লা-আবর্জনা মিশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
বিজয় সরণি মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের একজন সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে ভাস্কর্যটির বিশেষ গুরুত্ব নেই। কিছুদিন আগেও ভাস্কর্যটিতে অন্য পোস্টার ছিল। তিন-চার দিন আগে নতুন পোস্টার লাগানো হয়েছে।