ভিত্তি গড়ুন জনস্বাস্থ্যে

সঠিক জীবনবোধ স্বাস্থ্যবিধির চর্চা এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা, সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধির প্রতিরোধ এবং প্রতিকারে সবচেয়ে কার্যকর

জীবনের যে কয়েকটি মৌলিক বিষয় মানবসভ্যতার অস্তিত্ব ও উৎকর্ষকে চরমভাবে নিশ্চিত করে, স্বাস্থ্য তার মধ্যে অন্যতম। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিকভাবে সুস্থ থাকাই সুস্বাস্থ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছে, সেখানে রোগপ্রতিরোধ, জীবনের আয়ুষ্মান বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রচার ও মানোন্নয়নকে প্রধান ভিত্তি ধরা হয়েছে। এখন এই ভিত্তি যে সমাজ ও রাষ্ট্রে যতটুকু শক্ত অবস্থান নিতে পেরেছে, সেই রাষ্ট্র ও সমাজ ততটাই সুরক্ষিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশ্বের কমবেশি সব দেশেই জনস্বাস্থ্যের এই ভিত্তি খুবই নড়বড়ে। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় উন্নত এবং অনুন্নত মোটামুটি সব দেশেই লেজেগোবরে অবস্থা, যা চিকিৎসা খাতসহ স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই দুর্বলতা মূলত জনস্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব।

বর্তমানে বাংলাদেশ মহামারির চতুর্থ পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে। প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দেশে রোগীর সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে। ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৪ লাখ ১৪ হাজার ১৬৪ জন শনাক্ত হয়েছেন। এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৬ হাজার ৪ জন। এখানে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রায় ৭৮ শতাংশ লোক সুস্থ হয়েছেন। জনস্বাস্থ্যের ওপর এই রোগ উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে এবং এর ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। প্রতিরোধের সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপগুলোতে ছিল সমন্বয়ের অভাব, দক্ষতার অভাব এবং আস্থার অভাব। ধারণা করা হয়, আমরা সংক্রমণের প্রথম ঢেউই এখনো অতিক্রম করতে পারিনি। কোনো বৈজ্ঞানিক মডেল কিংবা গবেষণা নিশ্চিতভাবে সংকটের শেষ কবে হবে, তা নির্ধারণ করতে পারছে না। মনে রাখতে হবে, সংক্রামক ব্যাধির হুমকি করোনাকালের পরও থাকবে। পাশাপাশি আছে অসংক্রামক ব্যাধির ত্রাস। সুতরাং একটি জনস্বাস্থ্যনির্ভর স্বাস্থ্যকাঠামো এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। নিম্নলিখিত কিছু উদ্যোগ ও নীতিমালা বাস্তবায়ন করা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি।

স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার

জনগণের সার্বিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস বর্তমান স্বাস্থ্যকাঠামোয় সম্ভব নয়। বর্তমান স্বাস্থ্যকাঠামো ক্লিনিক্যাল সেবানির্ভর এবং এর ওপর ভিত্তি করেই অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা দানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পুরো কাঠামোয় জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, বরং জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসংক্রান্ত জনবলের সমান কিংবা বেশি জনস্বাস্থ্য জনবল সম্পৃক্ত করতে হবে। এ–সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সমান্তরালভাবে সমশক্তিসম্পন্ন জনস্বাস্থ্য প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জনস্বাস্থ্যসেবাকে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবা, রাষ্ট্রীয় অনুশাসন ও নেতৃত্ব, মানবসম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, তথ্য ও গবেষণা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্বন্ধীয় প্রযুক্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য উপাদানগুলো গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়োগ-নীতি, কর্মক্ষমতাভিত্তিক প্রণোদনা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের দক্ষতা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে ভালো বরাদ্দ থাকতে হবে এবং ধাপে ধাপে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এনে মোট বরাদ্দ এবং সেবাকে সমৃদ্ধ ও সর্বজনীন করতে হবে। শহুরে স্বাস্থ্যকে নিশ্চিত করার জন্য স্বতন্ত্র স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। মফস্বলে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় ও মহামারি প্রতিরোধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজপতি ও সচেতন মানুষের সমন্বয়ে টিম গঠন করতে হবে এবং তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনস্বাস্থ্যশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং বিএমডিসির মতো একটি স্বতন্ত্র অ্যাক্রিডিটেশন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে।

রাজনৈতিক সংস্কার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক চর্চায় ও প্রতিশ্রুতিতে জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতে জনগণের স্বাস্থ্যের বিষয়টি আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত থেকেছে। এত গুরুত্বপূর্ণ খাত উপেক্ষিত থাকলে জনজীবনের অন্যান্য সব প্রাপ্তি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই উপলব্ধি রাজনৈতিক চর্চায় আনতে হবে।

সংবিধানের ১৮(১) ধারায় জনস্বাস্থ্যবিষয়ক রাষ্ট্রের কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া আছে। ওই ধারণাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনস্বাস্থ্যকে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাভুক্ত করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নামের একটি পৃথক মন্ত্রণালয়ের চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। তা না হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগকে অধিক শক্তিশালী করতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়োগ-নীতি, কর্মক্ষমতাভিত্তিক প্রণোদনা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের দক্ষতা থাকতে হবে।

জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সেল গঠন

করোনা মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ সংক্রামক ব্যাধি মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক প্রতিনিধিসহ অন্য সবার সম্পৃক্ততায় একটি সামগ্রিক এবং সমন্বিত জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সেল গঠন করতে হবে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এই সেল মানুষের সব ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। এই সেলের জেলাভিত্তিক শাখা থাকবে এবং সংক্রামক ব্যাধির সুচিকিৎসার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের মতো জেলাভিত্তিক বিশেষ চিকিৎসা স্থান কিংবা কোয়ারেন্টিন সেন্টার থাকবে। বছরব্যাপী এ স্থানগুলোতে জনস্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সরকারি প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে।

করোনাকালে আমরা দেখেছি, হাসপাতালের বেড ও আইসিইউর জন্য অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। কোভিড এবং নন-কোভিড হাসপাতাল আলাদা করতে অনেক জটিলতা এবং সময়ক্ষেপণ হয়েছে। বাংলাদেশের সব হাসপাতাল ও ক্লিনিককে সতর্কতার সঙ্গে শ্রেণিভাগ করতে হবে, যাতে বিশেষ সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এই সেলের একটি গবেষণা বিভাগ থাকতে পারে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অন্যান্য গবেষক দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত ও করণীয় সরবরাহ করতে পারেন।

তথ্যপ্রযুক্তির সমৃদ্ধকরণ

সংক্রামক মহামারি মোকাবিলায় আমরা দেখেছি, তাৎক্ষণিকভাবে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন সূত্র থেকে রোগতত্ত্বসংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য নিয়ে এবং তা বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিশেষভাবে প্রস্তুত ও সক্ষম করে তুলতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন অ্যাপের ব্যবহার মহামারি প্রতিরোধে অনেক সাফল্য নিয়ে আসে।

জনস্বাস্থ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তি এখন একে অন্যের পরিপূরক ও ক্রমবর্ধনশীল। প্রতিটি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য শিক্ষার সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

টেকসই স্বাস্থ্যবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন

সঠিক জীবনবোধ স্বাস্থ্যবিধির চর্চা এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা, সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধির প্রতিরোধ এবং প্রতিকারে সবচেয়ে কার্যকর। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা, যেখানে-সেখানে কফ-থুতু না ফেলা, ধূমপান বন্ধ করা, রান্নাঘর কিংবা ঘরের ময়লা-আবর্জনা উপযুক্ত জায়গায় ফেলা, মশার প্রজননে সহায়ক এমন জায়গাগুলো পরিষ্কার রাখা, টিবি রোগী শনাক্তকরণ ইত্যাদি বিষয় বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্যসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিশেষত বায়োমেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস/পিপিইর জন্য আলাদা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাসহ করোনাকালে চর্চিত সব স্বাস্থ্যবিধি রাষ্ট্র, সমাজ এবং ব্যক্তির চর্চায় পরিণত করতে হবে। শিক্ষা কারিকুলামে বিষয়গুলোর যথাযথ অন্তর্ভুক্তি এবং প্রচারে সরকার ও মিডিয়াকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক, সরকারি মাঠকর্মী, নাগরিক সমাজ সংস্থা বা সিভিল সোসাইটি, সামাজিক সংগঠন বা ক্লাব, ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতায় এসব বিষয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দরজায় পৌঁছে দিতে হবে।

তাহলেই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। আমরা সেই সুন্দর বাংলাদেশের প্রতীক্ষায়।

ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক এবং পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

ডা. আবু জামিল ফয়সাল পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক। পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কার্যকরী সদস্য।