ভূমিকম্পঝুঁকি বিবেচনায় ভবনের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণ অপরিহার্য

১৮৯৭ সালের ১২ জুন এ অঞ্চলের ইতিহাসের ভয়াবহতম ভূমিকম্প আঘাত হানে। যাতে জীবন ও সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। দিনটি স্মরণ করে ১২ জুন বিএসআরএম নিবেদিত ভূমিকম্প–সচেতনতা দিবস ২০২১ উপলক্ষে ‘ভূমিকম্পঝুঁকি ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে প্রামাণ্যচিত্র ও ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতেই ‘ভূমিকম্পসহনশীল ভবন’ শিরোনামে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয় এবং পরে একই বিষয়ের ওপর আলোচনা করা হয়।

সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিচার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক, পিইঞ্জের গবেষণা ও উপস্থাপনায় ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের পাশাপাশি বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকিও বিদ্যমান। ভূমিকম্প দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণ করা হয়।

আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. আলী আকবর মল্লিক এবং অধ্যাপক ড. রাকিব আহসান। ওয়েবিনার প্রামাণ্যচিত্রে ভূমিকম্পের যে রূপ, তা তুলে ধরে হয়। প্রামাণ্যচিত্র দেখে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. আলী আকবর মল্লিক এবং অধ্যাপক ড. রাকিব আহসানের কাছে মতামত জানতে চাওয়া হয়। ড. আলী আকবর মল্লিক বলেন, ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে নির্গত শক্তি ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের মাটির স্তরের মাধ্যমে চতুর্দিকে তরঙ্গ আকারে প্রবাহিত হয়। এ তরঙ্গই মাটির স্তরের ওপর নির্মিত অবকাঠামোর ক্ষতিসাধন করে। ভবন, সেতু, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ওপর মাটির কম্পন সমানভাবে কাজ করলেও ভবনের ক্ষয়ক্ষতি, জীবন ও সম্পদহানির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

ড. রাকিব আহসান বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক বাড়ি খাল-বিল ভরাট করে তৈরি করা হয়। ভরাটের মাটির ধরন না জেনে বুঝে আমরা সেখানে বহুতল ভবন তৈরি করছি। এ কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা হতে পারে। আমাদের যথাযথ নিয়ম মেনেই ভবন তৈরি করতে হবে। তাহলে যেকোনো প্রকৃতির দুর্ঘটনা বা ভূমিকম্প থেকে ভবনগুলো কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।’

প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয়, ভূ-অভ্যন্তরে চলমান শিলায় যে পীড়ন শক্তি পুঞ্জীভূত হয়, সেই শক্তি হঠাৎ অবমুক্ত হলে ভূপৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনই হলো ভূমিকম্প। কোন আপদ কোথায় এবং কখন আঘাত হানবে, এ দুটি তথ‍্যের সমষ্টিই হলো আগাম সতর্কসংকেত। ভূ-অভ্যন্তরে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য কেন্দ্র বা উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে মানুষের সম্যক ধারণা থাকলেও কোথায় ও কখন ভূমিকম্প আপদ আঘাত হানবে, সেটা এখনো মানুষের অজানা।

ভূমিকম্পে সৃষ্ট মাটির তরঙ্গের মধ্যে অন্যতম ‘পি’ তরঙ্গ ও ‘এস’ তরঙ্গ। যেহেতু ভূমিকম্পের নিরাপদ ‘পি’ তরঙ্গের গতিবেগ, ক্ষতিকর ‘এস’ তরঙ্গের গতিবেগ অপেক্ষা বেশি, সেহেতু কোনো স্থানে ‘এস’ তরঙ্গ পৌঁছানোর আগেই ‘পি’ তরঙ্গ পৌঁছে যায়। আর সেই ‘পি’ তরঙ্গই ভূমিকম্পের আগাম সতর্কসংকেত।

বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো বেশ আগে থেকে জানতে না পারলেও স্থানভেদে ৬০ সেকেন্ড বা ৩০ সেকেন্ড বা অন্তত ১০ সেকেন্ড আগে ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায়। আর এই পূর্বাভাস কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের ভূমিকম্পের ঝুঁকি বহুলাংশে কমাতে সক্ষম হয়েছে।

দ্রুতগামী নিরাপদ ‘পি’ তরঙ্গ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কৌশল অবলম্বন করে আগুন লাগার আশঙ্কা বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব। তা ছাড়া, নির্মাণ সাইট, শিল্পকারখানা ও যানবাহনে আগাম সতর্কসংকেত কাজে লাগিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসন ও অফিস–আদালতে মানুষ নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। ফলে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে হ্রাস হয়।

আলোচকেরা জানান, ভবনের আকার, আকৃতি, কলাম, বিম, কংক্রিট ওয়াল ইত‍্যাদির অবস্থান ও দিক নির্ধারণে ভূমিকম্প বল বিবেচনায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। স্থাপত্য নকশা প্রণয়নে ভূমিকম্পের বল বিবেচনায় না রাখার কারণে ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্বাভাবিক সময়ে মাটির ধারণক্ষমতা ভালো থাকলেও ভূকম্পনে তা হ্রাস পেতে পারে। এমনকি কিছু মাটির গুণাগুণ পরিবর্তিত হয়ে তরল আকার ধারণ করতে পারে। নির্মাণ সাইটের মাটি, ভূমিকম্পের প্রভাবে তরলায়িত হওয়ায় এবং মাটির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় ভবন হেলে পড়ে এবং ধসে যায়।

সাধারণত, ভবনের ওপরতলাগুলোয় বাইরের চার দিকে এবং ভেতরে পার্টিশন ওয়াল দেওয়া হয়। কিন্তু নিচতলা গাড়ি পার্কিং বা অন্য কোনো কারণে ফাঁকা রাখা হয়। ফলে, নিচতলার ভূমিকম্প লোড নেওয়ার সক্ষমতা ওপরতলাগুলো থেকে তুলনামূলকভাবে কমে গিয়ে দুর্বল তলার সৃষ্টি করায় নিচতলা ধসে পড়ে। কলামের যে উন্মুক্ত দৈর্ঘ্য বিবেচনায় অ্যানালাইসিস ও ডিজাইন করা হয়, বাস্তব কাজের সময় সে উন্মুক্ত দৈর্ঘ্য ঠিক না রাখলে কলামের ওই স্থানে অপ্রত্যাশিত অতিরিক্ত ভূমিকম্পের চাপ পড়ে, যা কলাম বহন করতে না পারার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

‘বিম-কলাম কাঠামো পদ্ধতিতে’ একটি ভবন ভূমিকম্পসহনীয় হওয়ার পূর্বশর্ত হলো কলামের শক্তি তুলনামূলকভাবে বিমের শক্তির চেয়ে বেশি হওয়া। পক্ষান্তরে, বিমের তুলনায় কলামের শক্তি কম হলে ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। একটি ভবনকে ভূমিকম্পসহনীয় করতে ভবনের ফাউন্ডেশন, কলাম, বিম ও স্ল্যাবে কোথায়, কীভাবে রড বা রি-বার স্থাপন করতে হবে, বিল্ডিং কোডে তা বিস্তারিত বলা আছে। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ডিটেইলিং অনুসরণ না করা হলে ভূমিকম্পে ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূমিকম্প ভবনের ভিত বা ফাউন্ডেশনকে আন্দোলিত করার কারণে সম্পূর্ণ ভবন দুলতে থাকে। ভবনের ওপরতলা সবচেয়ে বেশি দোলে। দুটি ভবনের মধ্যে প্রয়োজনীয় দূরত্ব বা গ‍্যাপ না থাকলে পরস্পরের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আলোচকেরা ভূমিকম্পে ভবনের ক্ষতির প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার শুরুতেই ভবনের আকার, আকৃতি প্রতিসম বা সুষমকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়। যদি কোনো কারণে একান্ত পুরোপুরি সুষম করা সম্ভব না হয়, তাহলে ভবনের কাঠামোগত নকশা প্রণয়নে ডায়নামিক অ্যানালাইসিস করতে হবে; যদিও তা ব‍্যয়বহুল।

বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে নরম মাটি বা ভূমিকম্পে তরলায়িত হতে পারে—এমন মাটির ওপর ভবন নির্মাণ করতে হয়, যা ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনের কাঠামো নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণে মাটির তরলায়নের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কৃত্রিমভাবে মাটির শক্তিবৃদ্ধিকরণ অথবা সঠিকভাবে পাইল ডিজাইন করে ভবন নির্মাণ করতে হবে।

ভবনের নিচতলা খালি রেখে ভবন নির্মাণ বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায়, যা ভূমিকম্প বিবেচনায় নিরাপদ বিবেচিত নয়। ভবনের নিচতলা খালি রাখতে হলে কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর আলোচনায় জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড-২০২০ অনুযায়ী খালি নিচতলার কলামগুলো অন্তত চার গুণ বেশি শক্তিশালী করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তা ছাড়া উইং ওয়াল ব্যবহারের মাধ্যমে নিচতলার শক্তিবৃদ্ধির বিষয়ে মত দেওয়া হয়।

ভবনের অ্যানালাইসিসের সময় কলামের যে উন্মুক্ত দৈর্ঘ্য বিবেচনায় রাখা হয়, নির্মাণের সময়ও তা অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। দেয়াল বা অন‍্য কোনো কারণে উন্মুক্ত দৈর্ঘ্যের ব্যত্যয় ঘটলে ভবন ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কলাম ও দেয়ালের মধ্যে ফাঁকা রেখে অথবা ইটের দেয়লের বিকল্প হিসেবে কম শক্তির দেয়াল ব‍্যবহার করে ভবনকে এই ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা যায়।

ভবন নির্মাণে অবশ্যই বিমের চেয়ে কলাম অন্তত ১ দশমিক ২ গুণ বেশি শক্তিশালী করতে হবে। একটি ভবনকে ভূমিকম্পসহনীয় করতে ভবনের প্রতিটি জয়েন্টের বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ডিটেইলিং করতে হবে। ভূমিকম্পে ভবন সাধারণত দুলতে থাকে। কিন্তু ভবন দোলার প্রয়োজনীয় জায়গা না থাকলে একটি ভবন অন‍্য ভবনের ওপর আঘাতের কারণে দুটি ভবনই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দুটি ভবনের মধ‍্যকার ফাঁকা জায়গা বিল্ডিং কোড অনুযায়ী হওয়া দরকার। ভবনকে ভূমিকম্পসহনীয় করতে রডের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণে অবশ্যই বিলেট থেকে তৈরি নমনীয় রড ব‍্যবহার করতে হবে।

‘ভূমিকম্পঝুঁকি ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে প্রামাণ্যচিত্র ও আলোচনায় উঠে আসে ভূমিকম্প ঠেকানোর সক্ষমতা মানুষের না থাকলেও ভূমিকম্প দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসের কৌশল মানুষ আয়ত্ত করতে পেরেছে। ভূমিকম্পের আগাম সতর্কসংকেতের সুবিধা গ্রহণ করা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে জীবন রক্ষাকারী সেবাগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ কৌশল অবলম্বন করা, আগাম সতর্কসংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ অবস্থান নেওয়া এবং ভবন নির্মাণের প্রতি ধাপে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে ভূমিকম্প দুর্যোগঝুঁকি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে।

প্রামাণ্যচিত্র ও আলোচনার ওপর ভিত্তি করে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা কিছু সুপারিশ দেন। সেগুলো হলো আগাম সতর্কসংকেত কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাসকরণ জরুরি। ভূমিকম্পনপ্রবণ বাংলাদেশে প্রতিটি ভবনের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণে ভূমিকম্প বল বিবেচনায় রাখা। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ভূমিকম্পের সময় মাটির ভার বহনের ক্ষমতা কমে যাওয়া বা মাটির তরলায়িত হওয়ার বিষয়টি মাটি পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা। ভবনের আকার, আকৃতি ও কাঠামোবিন্যাস ভূমিকম্প বিবেচনায় হওয়া। ভবনের অ্যানালাইসিস ও নির্মাণের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষাকরণ।

গুণগত মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী বিশেষ করে বিলেট থেকে তৈরি নমনীয় রডের ব‍্যবহার নিশ্চিত করা। ভবনের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণের সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ নিশ্চিতকরণসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়।
লেখক: মোহাম্মদ আবু সাদেক, পিইঞ্জ, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ