ভেলুয়ার দীঘি কি হারিয়ে যাবে!

৫০০ বছর আগের লোককথাকে ঘিরে উদ্ভব হওয়া চট্টগ্রাম নগরের ভেলুয়া সুন্দরী দীঘিটি নজরদারির অভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। ছবিটি সম্প্রতি পাহাড়তলী এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো
৫০০ বছর আগের লোককথাকে ঘিরে উদ্ভব হওয়া চট্টগ্রাম নগরের ভেলুয়া সুন্দরী দীঘিটি নজরদারির অভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। ছবিটি সম্প্রতি পাহাড়তলী এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো

পরমা সুন্দরী ভেলুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে লুটে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এক সওদাগর। লুটেরা ওই বণিকের হাত থেকে ভেলুয়াকে উদ্ধার করা গেলেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। এখন একই পরিণতি বরণের হুমকিতে আছে চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ভেলুয়া সুন্দরী দীঘি।
প্রায় ৫০০ বছর আগের লোককথাকে কেন্দ্র করে উদ্ভব হওয়া দীঘিটিকে ঘিরে প্রায় তিন দশক ধরে চলছে দখলের মহোৎসব। এতে কমে আসছে দীঘির আয়তন। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা এসব দখলের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে দীঘিটি রেলওয়ের সম্পত্তি। ১৯৮২ সালে দীঘিটির দক্ষিণ পাশে পাহাড়তলী বাজারের জন্য কয়েকটি দোকান ইজারা দেয় রেলওয়ে। আর ১৯৮৪ সাল থেকে মাছ চাষের জন্য দীঘিটিকে ইজারা দেওয়া হয় রেলওয়ে স্কাউটকে। পরে তাদের কাছ থেকে জনৈক জামাল খান পুকুরটি মাছ চাষের জন্য নেন। এর পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় দীঘির চারপাশ দখল হতে শুরু করে। প্রায় ১৪ একর আয়তনের দীঘির আশপাশের কতখানি জায়গা অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে, সে হিসাব কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। অথচ ভেলুয়া সুন্দরীর দীঘিকে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে এটিকে সংরক্ষণের কথা বলা আছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাতেও (ড্যাপ)। দীঘিকে ঘিরে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক উন্নয়নের কথাও বলা আছে ড্যাপে।
সরেজমিনে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দোকান ও ঘরবাড়ি মিলিয়ে অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা তিন শতাধিক হবে। দীঘির উত্তর পাশে অনুমতি ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে আধা পাকা দোকান ও ঘরবাড়ি। পূর্ব পাশে রয়েছে কাঁচা ও আধা পাকা ঘর। দক্ষিণ পাশে ইজারা নেওয়া দোকানগুলোর পেছনে দীঘির পাড় দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে সারি সারি গুদামঘর। চারপাশ থেকে অবৈধ দখল থাকায় দীঘিতে যাওয়ার সহজ কোনো পথ নেই। নিয়মিত সেখানে মাছ চাষ হলেও বাজারের লোকজন ও ঝুপড়ির অধিবাসীরা গোসলসহ নিত্য কাজে দীঘিটি ব্যবহার করছে। নিয়মিত বর্জ্য ফেলার কারণে ধীরে ধীরে দূষিত হচ্ছে দীঘিটি।
এই দখলের পেছনে সরাইপাড়া ১২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ইসলাম খান, তাঁর ভাই মহানগর জাতীয় পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ওসমান খান, সহিদ খান, চাচাতো ভাই আশরাফ খান, স্থানীয় ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ সওদাগরসহ অনেকের নামে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অবৈধ দখলদারদের বিষয়ে রেলওয়ের করা একটি তালিকাতেও এদের নাম পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, গুদাম নির্মাণ করে দীঘি দখলের পেছনে সবচেয়ে বেশি হাত ইসলাম খান পরিবারের।
এ কথা স্বীকার করে ইসলাম খান বলেন, ‘রেলওয়ে যদি সরে যেতে বলে, আমি জায়গা ছেড়ে দেব। তবে বাজারের পেছনে দখলের সঙ্গে আমি জড়িত নই।’
অভিযোগ থাকা ফারুক ট্রেডার্সের মালিক সলিমুল্লাহ সওদাগর দাবি করেন, রেলওয়েকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে গুদামঘর নির্মাণ করেছেন তিনি। তাঁর কাছে এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র আছে।
দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে ওসমান খান বলেন, ‘পৈতৃক সূত্রে আমরা অনেক সম্পত্তির মালিক। অযথা কেন রেলের জায়গা দখল করব। যারা অভিযোগ করেছে, তারা মিথ্যা বলেছে। কারণ আমি নিজে অবৈধভাবে নির্মাণ করা গুদামঘর ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
সম্প্রতি দীঘিটি রক্ষার জন্য এলাকায় গড়ে উঠেছে ‘ভেলুয়া দীঘি রক্ষা কমিটি’। দীঘিটি বাঁচানোর দাবিতে গত নভেম্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।
রেলওয়ের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিমউদ্দিন বলেন, ‘দীঘিটি রক্ষায় আমরা আন্তরিক। সেখানকার অবৈধ দখলদারদের তালিকার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। যেকোনো দিন থেকে সেখানে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর ও চট্টগ্রামের ইতিহাস গবেষক শামসুল হোসাইন বলেন, ‘ভেলুয়ার দীঘি সাধারণ কোনো দীঘি নয়, এর সঙ্গে চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত। এখনি উদ্যোগ নেওয়া না হলে অনেক ঐতিহ্যর মতো এগুলোও বিলীন হয়ে যাবে।’