ভোরের পাখি মোহসিন

লকডাউনের সময়ও প্রতিদিন পত্রিকা নিয়ে পাঠকের বাড়ি, হাজির হয়েছেন মোহসিনছবি: কবির হোসেন

২৯ বছর ধরে মো. মোহসিন মোল্লার ঘুম ভাঙে ‘সুয্যি মামা জাগার আগে’, বেরিয়ে পড়েন তিনি। পত্রিকা সংগ্রহ করেন। পৌঁছে দেন বাড়ি বাড়ি। ঝড়, বৃষ্টি, রাস্তায় কোমরসমান পানি—কিছুই তাঁকে দমাতে পারে না।

হকার মোহসিন বলছিলেন, ‘ঈদের সময় বা কোনো কারণে পত্রিকা বন্ধ থাকলে ভালো লাগে না। ভোরবেলা বের হতে না পারলে শরীর ম্যাজম্যাজ করে।’ সেই ১৩ বছর বয়স থেকে বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করছেন। ২৯ বছরে কখনো পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবেননি। বলছিলেন, ‘এমন অনেকে আছেন, যাঁদের আমি ২২ বছর ধরে পত্রিকা দিই। আবার অনেকে ফজরের নামাজ পড়ে আমার অপেক্ষায় বসে থাকেন। পত্রিকা হাতে তুলে দিলে যখন হেসে বলেন, “মোহসিন ভালো আছো?”, আমার মন ভালো হয়ে যায়।’

করোনাকালে আর সব পেশার মতো মোহসিন মোল্লার প্রায় তিন দশকের নির্বিঘ্ন পেশাতেও বড় আঘাত এসেছে। অনেকে ঢাকা ছেড়ে বাড়ি চলে গেছেন। অনেক বাড়িতে পত্রিকা রাখা বন্ধ হয়েছে। কেউ কেউ ফোন করে বলেছেন, ‘মোহসিন, আমার তো পত্রিকা না পড়লে ভালো লাগে না। কিন্তু কী করব বলো? বাড়িওয়ালা নিষেধ করে দিয়েছেন, বাইরের কোনো কিছু ভেতরে ঢুকবে না।’

২৬ মার্চ পর্যন্ত তেমন কোনো সমস্যা হয়নি বলে জানালেন মোহসিন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে গুজব ছড়াল, পত্রিকার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায়। তখন অনেকেই পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কেউ কেউ আবার নিজের মতো করে সচেতন থাকতে চেষ্টা করেছেন। দরজার কাছে ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখেছেন। বলে দিয়েছেন, ‘ব্যাগের মধ্যে পত্রিকা রেখে যেয়ো’। কেউ পুরো পত্রিকায় জীবাণুনাশক স্প্রে করে তারপর হাতে নিয়েছেন। কেউ বলেছেন, ‘পত্রিকা লাগবে না। কিন্তু তুমি মাস শেষে বিলটা নিয়ে যেয়ো।’ মোহসিন মোল্লা রাজি হননি। বলেছেন, ‘সার্ভিস দেব না, দাম নেব কেন!’

ঢাকার কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি, হাতিরপুলের নানা এলাকা ঘুরে পত্রিকা দেন মো. মোহসিন মোল্লা। যখন কোনো কোনো এলাকা লকডাউনের আওতায় পড়ল, বাইরে বেরোনো নিয়ে ভয় কাজ করত সবার মধ্যেই। নিজের ও পরিবারের কথা ভেবে মোহসিনও যথাসম্ভব সতর্ক ছিলেন। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক তো ছিলই। বাড়ি ফিরে প্রতিদিন জামাকাপড় সব ডিটারজেন্টে ভিজিয়ে রেখেছেন, বারবার হাত ধুয়েছেন।

এখন এসব অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। পত্রিকার পুরোনো গ্রাহকেরা প্রায় সবাই পত্রিকা রাখতে শুরু করেছেন। তবে ব্যাচেলর, শিক্ষার্থীসহ অনেকে ঢাকা ফেরেননি। মোহসিন অপেক্ষায় আছেন, আবার হয়তো পুরোনো চেনা মুখগুলোর সঙ্গে দেখা হবে।


মো. সাইফুল্লাহ প্রথম আলোর সহসম্পাদক