ভ্রমণে নারীর খোলা দুয়ার

বাংলাবান্ধা িজরো পয়েন্টে চার ভ্রমণকন্যা
ছবি: সংগৃহীত

ভ্রমণ আমাদের শুধু আনন্দই দেয় না, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা অভিজ্ঞতা ও জীবনমুখী শিক্ষা। কিছু সৌন্দর্য আছে দুচোখ ভরে দেখতে হয়, কিছু শব্দ আছে মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। তাতে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়। আর ভ্রমণ সেই চোখ-কানের বিবাদ মেটানোর সুযোগ এনে দেয়। অথচ কী নিদারুণ দুর্ভাগ্য আমাদের! তথাকথিত নিরাপত্তার অজুহাতে, সামাজিকতার বিধিনিষেধ ও নানা ট্যাবুর কারণে বাংলাদেশের মেয়েরা তাদের এই শখটুকু পূরণ করতে পারে না।

বাংলাদেশে মেয়েরা সব ক্ষেত্রে ভালো করছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য ঈর্ষণীয়। পেশাজীবনেও তারা দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। ভ্রমণের ক্ষেত্রে তারা কেন পিছিয়ে থাকবে? ছেলেরা পারলে মেয়েরা পারবে না কেন? এসব ভাবনা থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের দুই শিক্ষার্থী বন্ধু–মানসী সাহা ও সাকিয়া হকের উদ্যোগে শুরু হয় ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ বা ভ্রমণকন্যার যাত্রা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন বন্ধু। ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকেন অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা, কর্মজীবী ভ্রমণপিয়াসীরাও। একশ, হাজার ছাড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’-এর সদস্যসংখ্যা এখন ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। চেনা গণ্ডির বাইরে একেবারে অপরিচিতা সবাই হয়ে উঠেছে পরম বন্ধু। তাদের সবার নাম ছাপিয়ে ‘ভ্রমণকন্যা’ পরিচয় যেন আজ মুখ্য হয়ে উঠেছে।

মানসী ও সাকিয়া স্কুটিতে করে ভ্রমণ করেছেন ৬৪ জেলা। এরপর সময় পেরিয়ে গেছে। ভ্রমণকন্যার দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা মানসী ও সাকিয়া দুজনেই এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দুজনেই বিসিএস ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা কর্মরত রয়েছেন উপজেলা পর্যায়ে। অনলাইনের মাধ্যমে চলছে ‘ভ্রমণকন্যা’র যোগাযোগের সব কাজ। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর যাত্রা শুরু করা ‘ভ্রমণকন্যা’। আর কিছুদিন পরেই পাঁচ বছর পূরণ করবে। মানসী সাহা সভাপ্রধান, আর সাকিয়া হক দায়িত্ব পালন করছেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। ২৫ জন কার্যরকরী সদস্য মিলে সফলভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে সকল কাজের।

ভ্রমণকন্যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মানসী সাহার সঙ্গে কথা হলো সেদিন। মানসী জানান, মেয়েদের জন্য দল বেঁধে নিরাপদ ভ্রমণের পরিকল্পনা আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভ্রমণকন্যা ধীরে ধীরে দেশের নারীদের আস্থার সংগঠন হয়ে উঠেছে। ‘ভ্রমণকন্যা’র সদস্যসংখ্যা বর্তমানে ৬০ হাজারেরও বেশি। এখন পর্যন্ত তারা দেশের ১০৬টি স্থানে ভ্রমণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে ৩৫-৪০ জন করে প্রায় সাড়ে চার হাজার মেয়ে ‘ভ্রমণকন্যা’র সঙ্গে সরাসরি ভ্রমণ করেছেন।

করোনাকালে সংগত কারণেই ভ্রমণবিষয়ক সব কার্যক্রম সীমিত ছিল। পঞ্চম বর্ষপূতি উৎসবের মাধ্যমে ২৭ নভেম্বর থেকে আবার উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে আবার সশরীর কার্যক্রম শুরু হবে এবং সেই সঙ্গে যুক্ত হবে নিত্যনতুন ভ্রমণসূচি।

২.

শুধু ভ্রমণই নয়, ভ্রমণের পাশাপাশি সাকিয়া হক ও মানসী সাহা ভ্রমণসূচিতে যুক্ত করেছেন নানা রকম সামাজিক কাজ, যার মূখ্য উদ্দেশ্য নারীর ক্ষমতায়ন। ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে স্কুটিতে চড়ে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন সাকিয়া ও মানসী। বিভিন্ন সফরে তাঁদের স্কুটিতে সহযাত্রী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ ভ্রমণে প্রতি জেলায় দুই-তিনটি করে স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা দিতে হাজির হয়েছেন এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। ৬৪ জেলার বিভিন্ন স্কুলে তাঁরা কথা বলেছেন প্রায় ৩২ হাজার মেয়ের সঙ্গে ।

‘ভ্রমণকন্যা’র আরেক প্রতিষ্ঠাতা ডা. সাকিয়া হক বলেন, ‘সবখানেই আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার ও কাঙ্ক্ষিত সহায়তা পেয়েছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য নারীদের সামনে এগিয়ে চলতে উদ্বুদ্ধ করা। কীভাবে দেশ দেখতে, চলতে, মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়; সেই ব্যাপারে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের চেষ্টা করেছি। আমরা কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন দৈহিক-মানসিক পরিবর্তন, বাল্যবিবাহের কুফল এবং আত্মরক্ষার বিষয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরেছি।’

জেন্ডার ইকুইটি অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের (জিপ) কাজ শুরু হয়েছে এ বছরের ১ সেপ্টেম্বর। সারা দেশে জিপের ভলান্টিয়ার সংখ্যা ১ হাজার ২০০। পাঁচ বছর মেয়াদি এ কার্যক্রমে ইতিমধ্যে জিপ প্রোগ্রামের আওতায় ১৫টি স্কুলে প্রজননস্বাস্থ্য, আত্মরক্ষা, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব স্কুলে ১ হাজার ৫৪ জন ছাত্রী অংশ নিয়েছেন।

ভ্রমণকন্যার আয়োজনে ২০১৬ সাল থেকে পরপর তিনবার ভ্রমণবিষয়ক তিনটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। এ বছর পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ভ্রমণকন্যা ম্যাগাজিনের চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।

এ ছাড়াও ‘শিক্ষণ’ নামে মেয়েদের জন্য সাইকেল প্রশিক্ষণ আর ‘ভ্রমণকন্যার ঘর’ নামে চলমান রয়েছে মেয়েদের জন্য নিরাপদ ও সুলভমূল্যে আবাসেনর সুযোগ।

৩.

বাংলাদেশের নারীদের, মানে আমাদের বাস্তবতা হলো, যখন মেয়েরা অভিভাবকের কাছে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনাটি জানায়, তখন অভিভাবকেরা মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রায় ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যান। কখনোবা রূঢ় হন। তাঁরা বুঝতে চান না, বাড়ির ছেলেটির মতো মেয়েটিরও ঘুরতে যাওয়াটা তার অধিকার। তাঁরা মেয়েটিকে বাধা না দিয়ে বরং এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারেন। কাদের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, কোথায় থাকবে, কোন কোন বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হতে পারে, তার খোঁজখবর নেওয়া ও দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।

আশার কথা বলে শেষ করি। ভ্রমণকন্যার ইতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোকে আরও অনেকেই এ ধরনের দলবদ্ধ ভ্রমণ কার্যক্রম শুরু করেছে, যেটা খুবই আশাজাগানিয়া। কেবল ‘ভ্রমণকন্যা’ নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে বাংলাদেশে গড়ে উঠছে অনেকগুলো মেয়েদের ভ্রমণের দল। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের এক হিসাবে এমন ২৭টি দলের খোঁজ পাওয়া গেছে, যার সদস্য শুধু মেয়েরা। তারা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন ফেসবুকে এবং একসঙ্গে মিলে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে বেড়াতে যাচ্ছেন। নিজেরাই আয়োজন করছেন সবকিছু। এসব গ্রুপের সদস্য মূলত তরুণ প্রজন্মের মেয়েরা। তাঁদের কেউ পড়াশোনা করছেন। কেউবা হয়তো তরুণ পেশাজীবী কিংবা বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত।

সবশেষে মেয়েদের বলব, সবাই এগিয়ে আসুন, চলুন, ভ্রমণের মাধ্যমে আমাদের জীবনের আরেক ধাপ বিকশিত করি। ‘ভ্রমণকন্যা’র জয় হোক, ভ্রমণকন্যাদের জয় হোক।

তাওহিদা জাহান: চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়