ভয়ংকর বিষধর 'রাসেল ভাইপার'

বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ২৫ বছর পর আবার ভয়ংকর বিষধর সাপ রাসেল ভাইপারের দেখা মিলছে। ইতিমধ্যে এই সাপের কামড়ে অসুস্থ তিনজনের হাত-পা কেটে ফেলেও বাঁচানো যায়নি। অপর একজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

আট দিন ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসার পর গতকাল সোমবার এক রোগীকে সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ওয়ার্ডে আসার পরে তাঁর অবস্থার অবনতি হয়েছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক সূত্র জানায়, ২০-২৫ বছর পরে বিলুপ্তপ্রায় এই সাপ বরেন্দ্র অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাসে রাজশাহীর তানোরের শিবরামপুর গ্রাম থেকে জার্মানির আন্তর্জাতিক বিষ গবেষণা কেন্দ্রের একটি দল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দুটি সাপ ধরে নিয়ে যায়। একটি সাপ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আজিজুল হক আজাদ নমুনা হিসেবে তাঁর কার্যালয়ে রেখেছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, প্রায় ২৫ বছর পর এই সাপ আবার দেখা যাচ্ছে। এই সাপে কামড় দিলে দ্রুত মানুষের শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। চিকিৎসা দেওয়ার প্রায় সময় পাওয়া যায় না। এই সাপ দু-তিন ফুট লম্বা হয়। বছরে দুবার ২০ থেকে ৩০টি ডিম দেয়।

গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি গ্রামের কৃষক আবদুর রউফ বলেন, তাঁদের এলাকায় নদীর ধারে প্রায় এ ধরনের সাপ দেখা যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে স্থানীয় জেলেদের জালে এ ধরনের একটি সাপ ধরা পড়ে। সাপটি ভীষণ গর্জন করছিল। এ রকম সাপ এলাকায় আগে কোনো দিন দেখা যায়নি। রাজশাহী চিড়িয়াখানায় খবর দেওয়া হলে সেখানকার লোকজন এসে বলেন, এমন ভয়ংকর সাপ পরিচর্যা করার মতো ব্যবস্থাপনা চিড়িয়াখানায় নেই। পরে জালসহ সাপ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। মাস দেড়েক আগে একজনকে তাড়া করলে তাঁরা একই ধরনের আরেকটি সাপ ধরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। তখন চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এই সাপের নাম ‘রাসেল ভাইপার’। তিনি বলেন, গত দুই মাসে তাঁদের এলাকায় দুজন সাপের কামড়ে মারা গেছেন। তাঁদের হাসপাতালে নেওয়ার সময় পাওয়া যায়নি। রাতের কারণে সাপও শনাক্ত করা যায়নি।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১১ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দ্র গ্রামের কৃষক আব্বাস উদ্দিনের ছেলে আনোয়ার হোসেনের (২০) হাতের আঙুলে এই সাপে কামড় দেয়। তাঁকে আট দিন হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। পরে হাতের আঙুলে পচন ধরে। তাঁর হাত কেটে ফেলার পর সারা শরীরে পচন ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

গত বছরের ১৩ নভেম্বর রাজশাহীর তানোর উপজেলার শিবরামপুর গ্রামের নওশাদ আলীর ছেলের আজিম উদ্দিনের (২৬) পায়ে এই সাপ কামড় দেয়। তাঁকেও নয় দিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু একইভাবে তাঁর পায়ের ক্ষতস্থানে পচন ধরে। পা কেটে ফেলার পরেও তাঁর মৃত্যু হয়।

গত বছরের ১ জুন নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদ্বিগুণ গ্রামের জামাল উদ্দিন এই সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। একইভাবে তাঁরও মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁকে সে সময় আইসিইউতে ভর্তি করা হয়নি।

এরপর ২১ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার খরচাকা গ্রামের মোহাম্মদ নান্টুর স্ত্রী শামীমা আক্তারকে পদ্মা নদীর ধারে সাপে কামড় দেয়। স্থানীয় লোকজন সাপটির গায়ে ফলা ঢুকিয়ে ধরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

হাসপাতালের আইসিইউর চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা বলেন, তিনি সাপ দেখেই চিনতে পারেন। এটি সেই ‘রাসেল ভাইপার’। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করেন। তিনি বলেন, আগের দুজন রোগীর হাত-পা কেটেও বাঁচানো যায়নি। আগেই তাঁদের কিডনি অচল হয়ে গিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি এই রোগীর চিকিৎসা দিতে থাকেন। চিকিৎসায় রোগী প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাঁকে গতকাল সোমবার হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। তিনি এখন হাসপাতালের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের ২১ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

তবে গতকাল বিকেলে রোগী শামীমা আক্তারের বোন রুমা খাতুন বলেন, তাঁদের রোগী এখনো সুস্থ হননি। সাধারণ ওয়ার্ডে নিয়ে আসার পরে তাঁর পা কিছুটা ফুলে গেছে। তিনি বসতেও পারছেন না, হাঁটতেও পারছেন না। এই ওয়ার্ডের চিকিৎসকেরা ছুটি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা ছুটি নিতে রাজি হননি।

এ ব্যাপারে চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা বলেন, তাঁকে আইসিইউ থেকে ছেড়ে দেওয়ার সময়ই তিনি বলে দিয়েছেন, এ রকম কিছু হলে আবার তাঁরা তাঁকে আইসিইউতে নিয়ে আসবেন।

গোলাম মোস্তফা বলেন, রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য তাঁরা সম্প্রতি একটি যন্ত্র পেয়েছেন। বাংলাদেশে শুধু রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এই যন্ত্র দেওয়া হয়েছে। তবে যন্ত্রটি চালানোর জন্য প্রতি ৭২ ঘণ্টায় একটি করে সার্কিটের প্রয়োজন পড়ে। সেটির দাম ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। সরকারিভাবে এই সার্কিটের কোনো সরবরাহ নেই।