ম-তে মধ্যবিত্ত, ম–তে মানিয়ে নেওয়া

‘মা খাইছ?’

দাসত্বের প্রথম প্রহর শেষে আমাদের মায়েরা একটু থামতেন। পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যটার দিকে চোখ ফেরাতেন একবার। লাল হয়ে যাওয়া গনগনে ওই আগুনগোলকটা আরও লাল হয়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে—লজ্জায়, কিছু না করতে পারার ব্যর্থতায়। ক্লান্তি আর ঘামধোয়ার গোসল সেরে, বিকেল শেষ হওয়ার আগে, মায়েরা খেতে বসতেন দুপুরের। কাঠের পিঁড়িতে কোনোরকম দেহ ঠেকিয়ে, তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন পাতিলের তলার ভাত আর উচ্ছিষ্টের মতো বেঁচে যাওয়া তরকারির ঝোলে। তারপর নিজের আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলতেন, ‘হ খাইছি, আল্লায় খাওয়াইলো।’

স্রষ্টা আমাদের মায়েদের খাওয়ান, খাওয়ান আমাদেরও।

২.

ঢাকা-১৬ আসনের এমপি আলহাজ মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ সাহেবের বাড়ি লাগোয়া একটি কাঁচাবাজার আছে মিরপুরে। পছন্দের সবজি কেনার জন্য মাঝেমধ্যে সেখানে যাওয়া হয়। অনেক ক্রেতার ভেতর মাঝবয়সী কয়জন নারীকে দেখা যায় প্রায়ই। বয়স হয়ে যাওয়াও অনেকে আসেন। কারও হাতে টাকা রাখার ছোট্ট পার্স, কারও টাকা থাকে হাতের মুঠোয়। প্রথম করোনার শেষের দিকে দেখি এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন স্থির হয়ে, এক কোনায়। সকাল পেরিয়েছে কিছুটা আগে। তেমন মানুষ নেই বাজারে। ঠিক কেমন যেন দেখাচ্ছে তাঁকে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখ তুলে তাকালেন তিনি। চিরায়ত মায়ের চেহারা। সোনালি ফ্রেমের পাতলা চশমা, তার ফাঁক দিয়ে চাহনি তাঁর। চোখে জল নেই, ভেজা ভেজা। দ্বিধা আর সংকোচ ঝেড়ে বললাম, ‘কোনো সমস্যা, আন্টি?’

হাসলেন তিনি। ষাটোর্ধ্ব মুখের হাসিতে মুক্তা ঝরল, বেদনাও। বুক স্পর্শ করা নীরবতা। আরও একটু কাছ ঘেঁষি তাঁর, ‘বলা যাবে সমস্যাটা? যদি কোনো অসুবিধা থাকে, দরকার নেই।’ আরও কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর জগতের সব লাজুকতায় বললেন, ‘টাকা হারিয়ে ফেলেছি।’

‘বাজারের টাকা?’

‘জি।’

‘কোথায় ছিল টাকাগুলো?’

ডান হাতটা মেলে দিলেন তিনি। মুঠো দেখালেন উল্টিয়ে।

বাকিটুকু আর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু দিব্যি দেখতে পাই—পেনশন কিংবা অন্য কোনোভাবে পাওয়া টাকাগুলো ভাগ করেন তিনি গুনে গুনে—বাড়িভাড়া, ডাক্তার, ওষুধ, বাজার, কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল—আরও কত-কী! মাঝে মাঝে গুনে গুনে খেতেও হয়। এরই মাঝে মাঝে অতিথি, অনাহূত শরীর খারাপ-ডাক্তার, কোনো একদিন টাকা হারিয়ে ফেলা। হিসাব আর মেলে না, যেমনটা মিলত না আগেও!

পাটভাঙা সুতি কাপড়টার দিকে তাকাই এবার। নিশ্চিত—কোনো ঈদে কেনা কিংবা কোনো এক আত্মীয়ের উপহার ওটা। রং ক্ষয়ে যাওয়া হাতের চুরিটা, তার চেয়ে উজ্জ্বলতায় জেগে ওঠা নীলচে রক্তনালি। তেল-নুনের সংসারে সেই কবেই ভাজা হয়ে গেছে জীবন, নুনে নুনে ভরে গেছে সময়!

৩.

দুদিন আগে বাজারে গিয়েছিলাম। বাজারের প্রথম দোকানদার জয়নাল। সারি সারি সবজির দিকে একপলক তাকিয়ে তার দিকে তাকালাম, ‘সবজি বিক্রি কি একটু কম নাকি জয়নাল?’

‘ইট্টু না ছার, অনেক। যারা এক কেজি কিনত, তারা এখন হাফ কেজি কেনে।’ পাশ থেকে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক বললেন, ‘কয়দিন আগে কোথায় যেন পড়লাম—আগে মানিব্যাগে টাকা এনে বাজারের ব্যাগে বাজার করা হতো, এখন বাজারের ব্যাগে টাকা এনে মানিব্যাগে বাজার করেন সবাই।’

৪.

মাঝে মাঝে একটা পোস্ট অফিসে যাই আমি। আমার এক বন্ধু সেখানকার পোস্টমাস্টার। প্রায়ই কাউন্টারের সামনে ভিড় লেগে থাকে। লম্বা ভিড়ের একদিন। বুড়ো এক মানুষ আঙুলের করে আঙুল বুলিয়ে হিসাব করছেন কিসের যেন—প্রচণ্ড মনোযোগে, চারপাশের সব কোলাহল কানে না নিয়ে।

‘কিসের হিসাব কষছেন?’

চোখ তুলে তাকালেন। তারপর স্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘জীবনের।’ প্রস্ফুটিত হাসি তাঁর।

‘জীবনের!’

‘এখন তো সংসারই জীবন, জীবনই সংসার।’

‘হিসাব মেলে?’

‘না।’ খানিকক্ষণ থেমে বলেন, ‘তবু মেলাতে হয়। এই যে সঞ্চয়পত্রের ইন্টারেস্টে সংসার চলত, ইন্টারেস্ট কমানো হয়েছে, ওদিকে দাম বেড়েছে জিনিসপত্রের।’ হাসলেন তিনি আবার। কত দিন আগে কিশোর কুমার গেয়েছিলেন—‘চোখের জলের হয় না কোনো রং, তবু কত রঙে ছবি থাকে আঁকা।’ মুখের হাসিরও হয় না কোনো রং, কিন্তু আঁকা থাকে অনেক ছবি—নানান রঙের, নানান বেদনার!

৫.

মাথাপিছু আয় বেড়েছে আমাদের কয়েক শ ডলার। নতুন রঙের নতুন আকারের গাড়িতে ছেয়ে গেছে আমাদের রাস্তা। কারুকাজময় লম্বা দালান আর উন্নয়নের স্মারকচিহ্নের উড়ালসড়ক ক্রমে ঢেকে দিচ্ছে আমাদের আকাশ। উত্তরোত্তর ধনী হচ্ছি আমরা। আমাদের দেশের ব্যাংকে সেসব টাকা রাখার জায়গা নেই, বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি চুপি চুপি। আমাদের ‘হোম’ও বেড়ে যাচ্ছে জিডিপির তালে তালে—মালয়েশিয়ায় হোম, সিঙ্গাপুরে হোম, কানাডা-আমেরিকায় হোম, আমাদের আভিজাত্যের ‘সেকেন্ড হোম’।

৬.

দাসত্বের প্রহর শেষে পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যটার দিকে আমাদের মায়েরা আর তাকান না। বড় একটা আলু, চকচকে একটা বেগুনের প্রত্যাশায় চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে তাঁদের। কিন্তু লাল হয়ে যাওয়া গনগনে সূর্যটা আগের মতোই লাল হয়ে যায় বেদনায়। আমাদের মায়েরা এখনো খেতে বসেন সেই বিকেলে। সংসারের অন্যদের কাছে নুন-ঝালের তারতম্য হয়, কিন্তু আমাদের মায়েদের কাছে হয় না—সারা দিনের নোনা স্বাদের ঘামে নোনতা থাকে তাঁদের মুখ, ঘানি টানার জ্বালায় ঝালে ভরে ওঠে তাঁদের বুক।

৭.

ক্ষমতাপ্রিয় মানুষদের একদিন পরীক্ষা করব আমরা—মধ্যবিত্তরা। যদি আমরা একটা মানুষ পাই, যিনি দিনের চব্বিশ ঘণ্টায় মাত্র একটা ঘণ্টা মধ্যবিত্তদের নিয়ে ভাবেন। তাঁকে পাওয়ার আনন্দে আমরা সবাই তারপর না খেয়ে থাকব সাত দিন। বেঁচে যাওয়া সাত দিনের ওই খাবারের টাকা দিয়ে তাঁর ভাস্কর্য বানাব দেশের আনাচকানাচে!

মধ্যবিত্তরা বেঁচে থাকার জন্য সব পারে। ‘উচ্চবিত্তরা খেলে জেতার জন্য আর মধ্যবিত্তরা খেলে না হারার জন্য।’ আমেরিকান লেখক রবার্ট কিয়োসাকির এই কথার সূত্রে এই মধ্যবিত্তরা এই না হারার খেলা খেলতে খেলতেই হারিয়ে যায় একদিন। কেউ তাদের তাই মান্য করে না, মনে রাখে না কোনো দিন কোনো অনাদরেও!