মংলা সমুদ্রবন্দর অভিযান

একাত্তরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের নিজেদের কলমে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের নানা দুঃসাহসী অভিযানের বর্ণনা। এসব লেখা নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে শিগগিরই বেরোবে মুক্তির লড়াই: মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধাদের কলমে একাত্তরের গৌরবময় যুদ্ধগাথা শিরোনামের বই। প্রকাশিতব্য এ বই থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু যুদ্ধের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো নৌ কমান্ডো মো. খলিলুর রহমানের মংলা সমুদ্রবন্দর অভিযানের কথা:

মো. খলিলুর রহমান

১৫ আগস্ট সকালে দলনেতা আহসান-উল্লাহ সব কমান্ডোকে জঙ্গলের কিনারে একত্র করে মুষ্টিবদ্ধ হাতে শপথ করালেন, ‘আমরা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করতে কার্পণ্য করব না।

বাঙালি যুবক যারা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে এখানে একত্র হয়েছি, সবাই একই মায়ের সন্তান, কেউ কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। শত্রুর ভয়ে ভীত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকব না।

যুদ্ধ শেষে হয়তো সবাইকে আর আমাদের মধ্যে দেখা যাবে না; কিন্তু শপথ করছি, যুদ্ধে কারও মৃত্যু ঘটলে আমরা আদর্শচ্যুত হব না।’ আবেগময় কণ্ঠে দলনেতা সবাইকে শপথবাক্য পাঠ করানোর পর আমরা অশ্রুসিক্ত হয়ে একে অপরের সঙ্গে বুক মিলিয়ে পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করলাম। সারা দিন উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটল।

চারদিকে কড়া নিরাপত্তা তৈরি করে নৌকা থেকে লিমপেট মাইন, ফিনস, ডেগার, এক্সপ্লোসিভ অস্থায়ী ঘাঁটিতে নামিয়ে দলনেতা, মুজিবুর, এমদাদ, ইমাম বারী, আফতাবউদ্দিন, সিরাজুল ও আমি মিলে প্রতিটি মাইনে ডেটনেটরাইজড করলাম। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা।

সবাই অল্পস্বল্প খাবার খেয়ে নিজ নিজ ফিনস, ডেগার, সুইমিং কস্টিউম, সেফটি ফিউজ জ্বালানোর জন্য পলিথিনে মুড়ে একটা দেশলাই নিলাম। পুরো শরীরে প্রচুর সরিষার তেল মেখে যাত্রার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।


এখান (সুতারখালী) থেকে বন্দরের দূরত্ব প্রায় বারো কিলোমিটার। নদপথে বন্দরে পৌঁছাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় নেবে। গাইডের পরামর্শে অস্থায়ী ঘাঁটি থেকে কিছু দেরিতে রওনার সিদ্ধান্ত নিলাম।

জোয়ার ও ভাটার সময় পর্যবেক্ষণ করে অপারেশনের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। রাত দুইটায় নদে ভাটার শেষ এবং জোয়ার শুরু হবে।

এ সময় নদে পানি স্থিতিশীল থাকবে। এই অবস্থায় কমান্ডোদের সাঁতরাতে কম পরিশ্রম হবে এবং মাইন স্থাপন করতে সুবিধা হবে। অন্যদিকে এই সময়ে ভাটার টানে কমান্ডোকে সাগরে ভাসিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সুতারখালী থেকে মংলা বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরুর পর সময় নির্ধারণের ভুল ধরা পড়ে। স্রোতের বিপক্ষে নৌকা চালিয়ে মংলা বন্দরে পৌঁছাতে ভোর হয়ে যায়।

বন্দরের বিপরীত পারে বানিয়াশান্তা গ্রামটি সম্পূর্ণ পতিতালয়।

এ পর্যন্ত এই এলাকায় কোনো প্রতিরোধযুদ্ধ না হওয়ায় পতিতারা আবাস ত্যাগ করেনি। কিন্তু এদিন সশস্ত্র কমান্ডোদের দেখে তারা ভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে।

গেরিলা দলের নেতা আফজাল ও আনোয়ার তাদের দৃঢ়ভাবে বুঝিয়ে যার যার ঘরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন। কমান্ডোরা পায়ে ফিনস পরে, গামছা দিয়ে মাইন ও এক্সপ্লোসিভ বুকে বেঁধে কোমরে একটি মাত্র ডেগার গুঁজে গ্রুপসহ সন্তর্পণে নদে নেমে হাতে হাত ধরে নির্দিষ্ট জাহাজের প্রতি সাঁতরে এগোতে থাকেন।

অপর তীরে বন্দরের মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। চারদিক ফর্সা হয়ে উঠেছে। দলনেতা আহসানউল্লাহ কেবল নিকটতম ছয়টি জাহাজে মাইন লাগানোর নির্দেশ দিলেন। কমান্ডোর সংখ্যা ৪৮ জন।

সুতরাং প্রতি জাহাজে আটজন কমান্ডোকে নির্দিষ্ট করা হলো, যাতে কোনো টার্গেট বিফল না হয়। তখন নদে প্রবল স্রোত। চারদিকে উজ্জ্বল আলো।

অনবরত গানবোটের টহল। সার্চলাইটের আলো থেকে নিজেকে লুকানোর জন্য প্রত্যেকের মুখের ওপর কচুরিপানা ধরে এগোতে থাকি।

কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ কমান্ডো দলকে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে সাময়িক অসুবিধা হলেও বিক্ষিপ্তভাবে সবাই মাইন স্থাপন করে জোয়ারে গা ভাসিয়ে প্রাণপণে সাঁতরে কূলে ফিরে আসি।

এরই মধ্যে শত্রু গানবোট তীব্র আলো ফেলে কমান্ডোদের ওপর দিয়ে টহল দিয়ে গেল। কিন্তু নিপুণ প্রশিক্ষণ কমান্ডোদের আত্মরক্ষায় কাজে লাগে। ডুব দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে গানবোট অতিক্রম করে আমরা তীরে চলে আসি।
১৬ আগস্ট মংলা বন্দরে কমান্ডোরা যখন প্রমত্ত পশুর নদের মাঝে জাহাজে মাইন লাগিয়ে তীরে ফিরছেন, তখন দিনের আলোয় জাহাজের ডেকে পাকিস্তানিরা বিক্ষিপ্তভাবে পায়চারি করছে। যখন মাইনের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে, তখন ঘড়ির কাঁটা সকাল ছয়টা ছুঁয়ে গেছে।

এরপর বিকট শব্দে একটির পর একটি বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। একই সঙ্গে নদীর তীরে নিরাপত্তার জন্য অবস্থানকারী যোদ্ধাদের এলএমজি দুটিও গর্জে ওঠে। পশুর নদের তীরে এক প্রলয়ংকরী অবস্থার অবতারণা হয়।

শত্রু গানবোটগুলো আচমকা আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে প্রথমে সাগরের দিকে দ্রুত পালিয়ে যায়। বাণিজ্যিক জাহাজগুলো গুরুতরভাবে আক্রান্ত বুঝতে পেরে একটানা বিপৎসংকেত বাজিয়ে উদ্ধারের জন্য এসওএস বার্তা পাঠাতে থাকে।

পরে পাকিস্তানি চারটি গানবোট বন্দরে ফিরে এসে হেভি মেশিনগান থেকে নদীর পশ্চিম তীরে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাতে থাকে।

নদীতীরের গাছপালা, বাড়িঘর ঝাঁজরা করে দেয়। গুলির শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকে। এর মধ্যে আমরা সব কমান্ডো অপেক্ষমাণ নৌকায় দ্রুত স্থান ত্যাগ করি।
নৌ কমান্ডো মো. খলিলুর রহমানের জন্ম ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০, সাতক্ষীরায়। ১৯৭১ সালে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডো হিসেবে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেন।

পরবর্তী সময়ে শিক্ষকতা, ব্যাংক ও টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। মুক্তিযুদ্ধে নৌ অভিযান ও নৌ কমান্ডোদের নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন।