মনের আলোয় সুরের বুনন

মা নাছিমা বেগমের সঙ্গে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই বোন শামছুন নাহার ও সাইমুন নাহার। ১৩ নভেম্বর সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের গোলাবাড়িয়া গ্রামে।  প্রথম আলো
মা নাছিমা বেগমের সঙ্গে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই বোন শামছুন নাহার ও সাইমুন নাহার। ১৩ নভেম্বর সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের গোলাবাড়িয়া গ্রামে। প্রথম আলো

১৩ বছরের শামছুন নাহার। জন্মের পর পৃথিবীর আলো দেখেনি। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, তার চোখের আলোর ফেরার সম্ভাবনা নেই। তাতে কী মনের আলোয় সুর বুনে চলে সে। থাকতে চায় না কারও বোঝা হয়েও।

কিশোরী শামছুন নাহারের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের গোলাবাড়িয়া গ্রামে। নানা হানিফ ভূঁইয়ার বাড়িতেই তাদের বসবাস। শামছুন নাহারের দাদার বাড়ি একই ইউনিয়নের পূর্ব ভাটেরখিল গ্রামে।

১৩ নভেম্বর হানিফ ভূঁইয়ার বাড়িতে কথা হয় শামছুন নাহারের মা নাছিমা বেগমের সঙ্গে। সেসময় বাড়িতে ছিলেন, তার বাবা বাহার উদ্দিন, নানা হানিফ ভূঁইয়াও।

শামছুন নাহার কারও বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। তাই তার খুব ইচ্ছা পড়াশোনা করে সমাজে অবদান রাখতে। কিন্তু বাবা-মায়ের আর্থিক দীনতায় পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। কণ্ঠও ভালো। এখন একটি সংগীত বিদ্যালয়ে মাসিক ৩৫০ টাকা বেতন দিয়ে গান শিখছে। সে বড় শিল্পী হতে চায়।

মা নাছিমা বেগম বলেন, সীতাকুণ্ডে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত কোনো বিদ্যালয় নেই। চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরস্থ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে নিয়ে যান। পড়াশোনার ব্যয় তাদের সামর্থ্যের বাইরে হওয়ায় সেখানে ভর্তি করাতে পারেননি। শুধু শামছুন নাহার নয়, তার একমাত্র বোন তিন বছরের সাইমুন নাহারেরও জন্ম থেকে চোখের দৃষ্টি নেই। 

৬ বছর বয়সে প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার কথা শামছুন নাহারের। অথচ ১৩ বছর পার করলেও এখনো প্রতিবন্ধী ভাতা জোটেনি তার। অভাবের সংসার তাই পড়াশোনা হচ্ছে না। 

নাছিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী দিনে ৩৫০ টাকা বেতনে একটি হোটেলের নাশতার কারিগরের কাজ করছেন। সংসারে টানাপোড়েন সামাল দিতে তিনিও সেলাই করেন নকশিকাঁথা। তা দিয়ে কোনোরকম চলে যায় তাঁদের।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তাঁদের ছেলে নেই। দুটি মেয়েরই জন্ম থেকে চোখে দৃষ্টি নেই। কিন্তু প্রতিবন্ধী ভাতা পায় না। অন্তত একটি মেয়ের প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে বিভিন্নজনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কয়েক বছর ধরে। গিয়েছিলেন এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও চেয়ারম্যানের কাছে। গিয়েছিলেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার দপ্তরেও। প্রতিবার যাওয়ার পর বলেন, নতুন করে কাগজপত্র জমা দিতে। জমাও দেন। কিন্তু কোনো কাজ হয় না।

কিশোরী শামছুন নাহার জানায়, সে চোখে দেখতে না পেলেও অনুমান করে চলাফেরা করতে পারে। কিন্তু অন্যের সাহায্য ছাড়া দূরে কোথাও যেতে পারে না।

উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্র জানায়, সীতাকুণ্ডে মোট ৬ হাজার ৪৯৭ জন প্রতিবন্ধী রয়েছে। ভাতা পায় ২ হাজার ২৯৮ জন। প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি প্রতিবন্ধী শিশু ভাতার আওতায় আসে।

জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফুন নেছা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, শামছুন নাহারের বিষয়টি কয়েক দিন আগে তিনি জেনেছেন। তাকে চলতি অর্থবছরে ভাতার আওতায় আনা হবে।

লুৎফুন নেছা বেগম আরও বলেন, কোনো প্রতিবন্ধী শিশুকে ভাতা দিতে হলে প্রথমে ডিজেবল ইনফরমেশন সিস্টেমে (ডিআইএস) তথ্য প্রদান করতে হয়। ওই তথ্যে ত্রুটি থাকলে ভাতার আওতায় আনা যায় না।