মহামারিতে ব্যাংকিং সেবা ও বেতন হ্রাসে ব্যয়সংকোচন নীতি

যুক্তরাজ্যে Banker এবং Drunker-দের নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে কিছু কথা প্রচলিত আছে। ব্যাংকাররা প্রয়োজনে অনেক রাত অবধি কাজ করে থাকেন। তাই কাজ শেষে অফিস থেকে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়। ততক্ষণে Drunker-রাও রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু পুলিশ দূর থেকে Drunker এবং Banker-দের অনুধাবন করতে না পেরে কাছে গিয়ে গন্ধ শুঁকে নিত। আর তাতেই বুঝে নিতে পারত কে Banker বা কে Drunker!

হ্যাঁ, বলছিলাম ব্যাংকারদের কথা। সারা দিন পরিশ্রম করে কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। যুগ যুগ ধরে ব্যাংকারদের পরিশ্রমের কথা উঠে এসেছে বিভিন্ন কাহিনির আলোকে। ব্যাংকে প্রবেশ করার সময় থাকলেও বের হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই! যদিও অফিস কর্মঘণ্টা সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্ধারিত। অফিসের নির্ধারিত কাজ শেষ করে তবেই বের হওয়ার পথ খুঁজতে হয়। ব্যাংককে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই মুখ্য উদ্দেশ্য নিহিত থাকে।

ব্যাংক কিংবা ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো তথ্য আমাদের সামনে চলে এলেই অর্থনীতির ব্যাপারটাও চলে আসে। ব্যাংকের মাধ্যমেই টাকার দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো হয়। কাজেই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংক সহায়তা করে। বলতে গেলে, ব্যাংককে দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিও বলা যেতে পারে।

বর্তমানে সংক্রমিত এই মহামারির সময়ও প্রথম থেকেই জীবন বাজি রেখে সারা দেশে কাজ করছেন ব্যাংকাররা। অন্য অফিস-আদালত বন্ধ থাকলেও দেশে এক দিনের জন্যও ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকেনি। যদিও স্ব স্ব অফিসে উপস্থিত হয়েই ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে হয়েছে। বাসায় বসে কাজ করা সম্ভবপর নয়, তথাপি নিজেদের দায়বদ্ধতাস্বরূপ দেশের স্বার্থে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। ব্যাংকের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে অর্থনীতির সম্পর্ক। সে জন্যই দেশে সাধারণ ছুটি বিদ্যমান থাকলেও বিভিন্ন স্থানে ব্যাংকিং কার্যক্রম সচল রাখতে হয়েছে। এটা যেমন অর্থনীতির চাকা চালু রাখার হাতিয়ার, তেমনি জনগণের সেবামূলক কার্যক্রমও বটে।

ফলস্বরূপ কেউবা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরই মধ্যে কেউ না ফেরার দেশে চলে গেছেন, আবার কেউ কেউ নতুনভাবে করোনায় সংক্রমিত হচ্ছেন। কিন্তু কখনো কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা অশনিসংকেতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে অপারগতা প্রকাশ করেননি। বর্তমান এই মহামারির সময়ও ব্যক্তিস্বার্থ উপেক্ষা করে স্বল্প সময়ে দ্রুততম সেবা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। ব্যাংকিং খাতে চিরচেনা দৃশ্য শুধু বর্তমান এই মহামারির সময়ই নয়, বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকদের সুচারুরূপে সার্ভিস প্রদানের মাধ্যমেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পেরেছে। যেমন পোশাকশ্রমিকদের বেতন-ভাতা বা বোনাস পরিশোধের জন্য ঈদের আগের দিনও ব্যাংক খোলা রেখে সেবা প্রদানে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। আয়কর প্রদানের নিমিত্তে বিশেষ কোনো দিন ব্যাংক খোলা রেখে সেবা প্রদানে ব্রতী থাকছেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও ব্যাংকাররা দেশের স্বার্থে কিংবা সমাজের স্বার্থে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বিভিন্ন বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে স্বাবলম্বী করতে ব্যাংকাররা প্রতি ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। সার্ভিস প্রদানে কখনো কার্পণ্যবোধ কাজ করে না। সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিবেদিতপ্রাণ বলা চলে।

একটি দেশে দুর্যোগ মুহূর্তে অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় যে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তার চেয়েও বেশি নেতিবাচক প্রভাব ঘনীভূত হয়ে আসে দুর্যোগ-পরবর্তী সময়গুলোতে। সে জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমান এই সংকটময় মুহূর্তে দেশের প্রান্তিক কিংবা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিতকরণের লক্ষ্যে কুটিরশিল্প, মাইক্রো ক্রেডিট, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে স্বল্প সুদে বিনিয়োগ সুবিধা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। মহামারি প্রাদুর্ভাবের কারণে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। তাই খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার নিমিত্তে কৃষিতে শস্য ও ফসল চাষের জন্য ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদ হারে ঋণ বিতরণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়াও ‘কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃ অর্থায়ন স্কিম’-এর আওতায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিতরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইতিমধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক দুগ্ধজাত দ্রব্যের ওপর ঋণ প্রদানে গুরুত্ব আরোপ করেছে। মহামারির এই সংকটকালীন মুহূর্তে দুগ্ধ খামার থেকে দুধ বিক্রি করা অসাধ্য হয়ে উঠেছে। তাই সেদিকে খেয়াল রেখে দুধ থেকে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির জন্য ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

তবে মহামারির প্রকোপের কারণে যেমন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে মন্দাভাব চলে এসেছে, তেমনি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। তাই ঋণ আদায় করা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে আসছে এবং আমানতের পরিমাণও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো আগে থেকেই মন্দ ঋণের বোঝা বয়ে চলেছে। মহামারির প্রকোপ বিবেচনায় বিতরণ করা ঋণের কিস্তি আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিশোধ না করলেও খেলাপি ঋণে পরিণত হবে না। তাই ঋণ পরিশোধেও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

ব্যাংক কর্তৃক বিতরণ করা ঋণের সুদ হলো আয়ের অন্যতম একটি খাত। মহামারির কারণে গত এপ্রিল এবং মে মাসে ঋণের সুদ স্থগিত করায় আয়ের খাত অনেক সংকুচিত হয়ে এসেছে। তা ছাড়া গত এপ্রিল থেকে ঋণ-আমানতের সুদের হার নয়-ছয় কার্যকর হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারণ, প্রতিটি ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণ থেকে পাওয়া সুদ আয়ের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। আবার বিভিন্ন ধরনের ফি এবং কমিশন ব্যাংকের আয়ের অন্যতম একটি উৎস। অথচ অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ফি, কমিশন, অনলাইন চার্জ আদায় করা হয় না। অন্যদিকে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আমানতকারীদের আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে অনেক সুদ প্রদান করতে হয়। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় মহামারির প্রকোপের মধ্যে ব্যাংকের আয় খাতের ওপর যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়। মূলত নন পারফরর্মিং সম্পদ বৃদ্ধি এবং আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে মুনাফা কমে আসছে।

বর্তমান এই পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। তাই এই সংকট থেকে উত্তরণের নিমিত্তে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরনের পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এতে করে স্বাভাবিকভাবে কিছু মানুষ কাজ হারানোর ঝুঁকিতে থাকবেন, যা একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে স্থবির অর্থনীতিতে গতি ফিরে না আসা পর্যন্ত চলতে থাকবে। ইতিমধ্যে অনেক দেশে বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যায়। ব্যাংকিং সেক্টরেও প্রভাব বিদ্যমান।

সম্প্রতি বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ১৩ দফা পরামর্শ জারি করেছে। এর মধ্যে একটি হলো কর্মীদের ১৫ শতাংশ বেতন কমিয়ে নিয়ে আসা। ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক বেতন কমানোর পরিপত্র জারি করে ফেলেছে। অথচ এই সংকটময় মুহূর্তে ব্যাংকারদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা বিবেচনাপূর্বক তাঁদের উজ্জীবিত রাখার কথা ছিল। এই সময়ে একজন ব্যাংক কর্মীর বেতন হ্রাস করা মানে পুরো ব্যাংকিং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলা, কাজ করার মনোবল ভেঙে দেওয়া। অথচ এই ক্রান্তিকালে ব্যাংকাররাই কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বিতরণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে সত্যিকার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে বের করে নিয়ে আসবেন। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে ব্যবসায়ের ক্ষতি নিরূপণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাজটি করতে হবে অত্যন্ত দক্ষতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে। দুর্যোগের এই সংকটের মুহূর্তে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনতে ব্যাংকাররাই সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে পারেন। মহামারির এই সংকটের সময় ব্যাংকের কর্মীদের বেতন কমানো হলে কথা থেকেই যায়। অথচ এই সংকটময় মুহূর্তে কর্মীদের উদ্বুদ্ধকরণে আরও উৎসাহব্যঞ্জক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া যেত।

ব্যাংকের আয় খাতের মূল ভিত্তি ব্যাংকাররাই গড়ে তোলেন। অথচ আয় সম্প্রসারণের মূল বাধা হিসেবে যদি তাঁদেরই সামনে নিয়ে আসা হয়, তবে কথা থেকে যায়। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই সে প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ। তাই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে ওই প্রতিষ্ঠানকে কর্মীবান্ধব হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই মুনাফা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে ব্যাংকগুলো চলে আসে। তাই কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন অত্যাবশ্যক। অন্যথায় আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।

সে দিক বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকে ব্যয় হ্রাস করার অনেক পন্থায় কাজ করা যেতে পারে। সেটা হতে পারে কিছু কিছু ব্যয় খাতসংশ্লিষ্ট কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে। ব্যাংক ভবনগুলোর সাজসজ্জা কিংবা ভবন ভাড়া কমিয়ে। স্টেশনারি সামগ্রী ব্যাংকিং সেক্টরে অনেক ব্যয়বহুল একটি খাত। সে ক্ষেত্রে লাগাম টেনে পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের কথা চিন্তা করা যেতে পারে, যা গ্রিন ব্যাংকিংয়ের একটা অংশ। গ্রিন ব্যাংকিং অনেক আগে থেকে শুনে এলেও তার বাস্তবায়ন ব্যাংকগুলোতে নেই বললেই চলে। গ্রাহক আপ্যায়নে কিংবা প্রশিক্ষণের মতো জায়গাগুলোতে ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। লেনেদেনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের চার্জ আরোপ করা যেতে পারে। এ ছাড়া এমন অনেক খাত আছে যে খাতগুলো থেকে ব্যয় হ্রাস করা হলেও সমগ্র ব্যাংকের ওপর তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।

বর্তমান মহামারির এই সময়ে সবাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছেন। তার ওপর বেতন কমালে ব্যাংকারদের ওপর অর্থনৈতিকভাবে আরও নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। তবে, আশার কথা হলো, ইতিমধ্যে অনেক ব্যাংক বেতন না কমানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা অতি বিচক্ষণতার পরিচায়ক। এতে ব্যাংকগুলোকে যথেষ্ট কর্মীবান্ধব বলেও মনে হয়েছে। আশা করি মহামারির প্রকোপ বিদায় নিয়ে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে সব নেতিবাচক কিংবা বিরূপ প্রভাব দূর হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।

*ব্যাংকার