
আতাইকুলা বাজারে সূচনা। পাবনা শহর থেকে ঢাকায় ফিরছি। শ্যামলী পরিবহনের একিট বাসে। বাস ছেড়েছিল ঠিক সময়েই, সকাল ১০টায়। মোটামুটি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথ। পাবনা শহরের আবদুল হামিদ রোডসহ কেন্দ্রীয় এলাকা যানজটে প্রায় অচল। তাই শহরের ট্রাফিক মোড়ের প্রথম আলো কার্যালয় থেকে হাতে খানিকটা সময় নিয়ে সকাল নয়টার দিকে রওনা হয়েছি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের দিকে।
অর্ধেকেরও বেশি আসন খালি, ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে অবস্থাটা এ রকমই হয়। ঢাকার দিক থেকে আসার সময় আসন পরিপূর্ণ। ঈদ যত এগিয়ে আসবে, ঢাকায় ফিরে যাওয়ার সময় আসন ততই শূন্য। আবার ঈদের পরের চিত্র ঠিক এর উল্টো। টিকিট দেখতে এলে কর্তব্যরত ‘সুপারভাইজার’কে রাস্তার অবস্থা কেমন জানাতে চাইলে তিনি জানালেন, গতকাল পর্যন্ত তেমন যানজট ছিল না। অভয় দিলেন আজকেও (গতকাল রোববার) ততটা সমস্যা হবে না। তবে তাঁর অভয়বাণী যে বিফলে যাচ্ছে, অচিরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। আতাইকুলা এসে থেমে গেল গাড়ি। দূরত্ব ২৫-২৩ কিলোমিটার হবে পাবনা থেকে। রওনা দিয়েছি সবে আধা ঘণ্টা আগে।
আতাইকুলায় কোরবানির পশুর হাট বসে সড়কের পাশেই। সড়কজুড়ে ট্রাক আর ভটভটির জটলা। গরু-মহিষ-ছাগল নামানো হচ্ছে হাটে। মিনিট দশেক আটকে থেকে মুক্তি মিলল এখান থেকে।
দ্বিতীয় দফা আটকা পড়তে হলো কাশিনাথপুর মোড়ে এসে। এখানকার পরিস্থিতি আরও জটিল। পাবনা, নগরবাড়ী ও সিরাজগঞ্জের দিক থেকে রাস্তা এসে মিলেছে এই মোড়ে। গরুর ট্রাক, ভটভটি, ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশাভ্যান—কী নেই? ফুটপাতে দোকান। বৃষ্টি ছিল সকাল থেকেই। মাঝে মাঝে ঝরছিল ছিটেফোঁটা। কাদাপানিতে সয়লাব। ট্রাফিক পুলিশ হয়তো কোথাও আছে। তবে তাদের চাক্ষুষ করা যাচ্ছিল না গাড়ির ভেতর থেকে। এখানে আরও প্রায় ১৫ মিনিট আটকে থেকে বেড়ায় এসে পৌঁছানো গেলা দুপুর ১২টার কয়েক মিনিট পরে। কয়েকজন যাত্রী ছিলেন। বেজার মুখে তাঁরা উঠলেন। বিলম্বের কৈফিয়ত চাইলেন সুপারভাইজারের কাছে। এখানে গাড়িটি আসার নির্ধারিত সময় ছিল ১১টা ১৫ মিনিট।
এরপর শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়ায় একই ঘটনা। প্রতিটি বাজার, গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রায় অবধারিতভাবে এসে থেমে যাচ্ছে গাড়ি। কোথাও ৫ মিনিট কোথাও ১০-১৫ মিনিট আটকে থাকতে হচ্ছে। এভাবেই গাড়ি এল সিরাজগঞ্জ মোড় পর্যন্ত। তারপর এক ছুটে যমুনা সেতুর আগে এক হাইওয়ে রেস্তোরাঁয়। এখানে আবার নির্ধারিত যাত্রাবিরতি ২০ মিনিট। যাত্রীরা নেমে গেলেন যে যাঁর মতো।
হাইওয়ে রেস্তোরাঁ থেকে যাত্রা করে যমুনা সেতু পার হয়ে সাবলীল গতিতেই ছুটছিল বাস, মাঝে মাঝেই গরুর ট্রাকগুলোকে পাশ কাটিয়ে। গরুর ট্রাকগুলোর গতি একটু ধীর। খেয়াল করে দেখলাম, অন্য সময় ট্রাকে যেভাবে গরু-মহিষ আনা হয়, কোরবানির গরুর ট্রাকের চেহারা তার চেয়ে আলাদা। ট্রাকের দুপাশে উঁচু বাঁশের খুঁটি বেঁধে তার ওপরে তৈরি করা হয়েছে মাচান। মাচানের ওপরে খড়, ভুসির বস্তা, কাঁচা ঘাস ইত্যাকার গো-খাদ্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা। গরু কবে বিক্রি হবে ঠিক নেই। সে কারণেই প্রতিটি ট্রাকেই দেখলাম যথেষ্ট খাবার মজুত করা। দুপাশের প্রাকৃতিক শোভাও মনোহর। থই থই পানির মধ্যে ভাসছে কচুরিপানা আর কলমিলতা। কোথাও কোথাও মাথা দোলাচ্ছে কাশফুল।
এই দৃশ্যগুলোই বেশ বিরক্তিকর হয়ে উঠল টাঙ্গাইল বাইপাস পেরিয়ে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাসের গতি ক্রমেই মন্থর হয়ে আসছিল। বোঝাই যাচ্ছিল সমানে জটলা সৃষ্টি হয়েছে। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে এসে একেবারে থেমে গেল বাস। জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখা মিলল বাস-ট্রাক-ব্যক্তিগত গাড়ির লম্বা সারির, দৃষ্টি যত দূর যায়।
একটু যায় একটু থামে—এই করে করে চন্দ্রা মোড়ে বাসটি এল বিকেল চারটা নাগাদ। চন্দ্রা মোড়ে থেকে আবার বাইপাইল পর্যন্ত বেশ একটানাই আসা গেল। তারপর আবার অচলাবস্থা। এবার জট লেগেছে আশুলিয়া মোড়ের কাছে। সেই জটলা পেরিয়ে নবীনগরের মোড়ে (জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে) আরেক দফা জটলা পার হয়ে সাভারে আসতে পাঁচটা পেরিয়ে গেল। আশ্চর্য হলাম সাভারে তেমন জটলা না দেখে। তবে তা কাটতে সময় লাগল না। আটকে পড়তে হলো আমিনবাজারের আগে। অসহ্য দীর্ঘ সময়। ট্রাকগুলো আমিনবাজার সেতু পার হয়ে গাবতলী হাটে ঢুকছে। আবার হাট থেকে খালি ট্রাক বেরিয়ে আসছে। সেতু পেরিয়ে আসতেই আধা ঘণ্টার বেশি চলে গেল। আজান হলো মাগরিবের। টেকনিক্যাল মোড়ে এসে এসে নামলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা। এখনো তো রাজধানী থেকে ঈদের ঘরে ফেরার ঢল নামেইনি।
তবে সাড়ে আট ঘণ্টায় পাবনা থেকে ঢাকায় পৌঁছালেও যাত্রা তখনো শেষ হয়নি। মফস্বলীয় জট থেকে এসে পড়ল রাজধানীর রাজকীয় জটে। গন্তব্য সিদ্ধেশ্বরী। ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে থেমে থেমে এগোচ্ছিল সিএনজিচালিত অটোরিকশা। কথায় কথায় চালক জানালেন, ঢাকায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে সারা দিন। মৌচাকের ওদিকে দুপুর পর্যন্ত পানি ছিল। বাসার সামনে এসে দেখি পানি পুরো নামেনি, যেন সন্ধ্যার আগতদের অপেক্ষায়।