মা-বাবার বিচ্ছেদ, জন্মসনদ পেতে সন্তানদের হেনস্তা

বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সন্তানেরা ডিজিটাল জন্মসনদ পেতে অসম্মানজনক পরিস্থিতির মুখে পড়ছে। স্বজনদের অভিযোগ, মা–বাবা দুজনের সঙ্গে বা যেকোনো একজনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন শিশুদের জন্মসনদের আবেদন ফরমে বাবা বা মায়ের নামের জায়গায় ‘অজ্ঞাত’ লিখতে বলা হচ্ছে। এটাকে শিশুদের জন্য অবমাননাকর ও অমর্যাদাকর উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিশুদের স্বজনসহ অধিকারকর্মীরা।

তাঁরা বলছেন, জন্মনিবন্ধন করতে গেলে আইনের দোহাই দিয়ে মা–বাবা দুজনের জন্মসনদ চাইছে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় এবং স্থানীয় প্রশাসন। সেটা দিতে না পারলে মা–বাবার নামের জায়গায় তারা ‘অজ্ঞাত’ লিখতে বলছে। শিশুদের মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইনে সংশোধন দাবি করেছেন স্বজনেরা।

আবেদন ফরমে ‘অজ্ঞাত’ না লেখায় ছয় মাস ধরে ঘুরেও এক কিশোরীর ডিজিটাল জন্মসনদ পাননি তাঁর অভিভাবক। কিশোরীর জন্ম ২০০৬ সালে। ওই বছর মেয়েটির মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। মায়ের সঙ্গে সে নানাবাড়িতে বসবাস শুরু করে। ২০০৯ সালে অসুস্থতায় মা মারা যান।

একটি শিশুরও আত্মসম্মান আছে। ধরা যাক, যে বাবা এত বছরেও খোঁজ করেননি, এখন জন্মসনদের জন্য ‘ঠেকায়’ পড়েছে বলে শিশুটিকে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে?
মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

মেয়েটির খালু প্রথম আলোকে জানান, মেয়েটি এখন রাজধানীর একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ২০১১ সালে কিশোরীর মা-বাবার নাম দিয়েই তার জন্মসনদ করা হয়। ওই সময় শিশুর জন্মসনদ পেতে মা-বাবার জন্মসনদের কোনো প্রয়োজন হতো না। এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাল জন্মসনদের প্রয়োজন হওয়ায় পুরোনো হাতে লেখা সনদের নম্বরটি অনলাইনে তোলার চেষ্টা করেন তিনি। তখন জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় তাঁকে নতুন করে আবেদন করতে বলে এবং এর জন্য মা-বাবার জন্মসনদ চায়। খালু জানান, মেয়েটির মায়ের জন্মসনদ তাঁদের কাছে আছে।

কিন্তু বাবারটা নেই। বাবা কোথায় থাকেন, কী করেন, সে সম্পর্কে তাঁদের কিছু জানা নেই। এই তথ্য জানানোর পর জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় থেকে তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয়, নতুন জন্মসনদ নিতে ফরমে বাবার নামের জায়গায় ‘অজ্ঞাত বা অপ্রাপ্য’ লিখে দিতে। খালু জানান, অজ্ঞাত বা অপ্রাপ্য লিখলে মেয়েটির তো পিতৃপরিচয় থাকবে না। এটা মেয়েটার জন্য চরম হেনস্তাকর, অপমানজনক। সামাজিকভাবে সে হেনস্তারও শিকার হবে। ফলে তিনি নিবন্ধন ফরম পূরণ না করেই ফিরে আসেন।

মা-বাবার নামের জায়গায় ‘অজ্ঞাত’ লিখতে আপত্তি জানানোয় জন্মসনদ পায়নি বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (লিডো) আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা সাত শিশু।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮–এর মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা হয়। কাজটিকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নির্দেশিকা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার ৩(গ) ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি এতিম, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, পিতৃ-মাতৃপরিচয়হীন, পরিচয়হীন, বেদে, ভবঘুরে, পথবাসী বা ঠিকানাহীন বা যৌনকর্মী হলে নিবন্ধক তথ্যের ঘাটতির কারণে ওই ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যুনিবন্ধন প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না এবং এ ক্ষেত্রে যেসব তথ্য অসম্পূর্ণ থাকবে, সেসব স্থানে ‘অপ্রাপ্য’ লিখে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করতে হবে। কিন্তু আইনে মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে সন্তানের জন্মসনদের বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা নেই।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল পলাশ কান্তি বালা প্রথম আলোকে বলেন, আইনে সংশোধন না আসা পর্যন্ত তাঁদের এ ব্যাপারে কিছু করার নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মা-বাবার নামের জায়গায় ‘অজ্ঞাত বা অপ্রাপ্য’ লেখার বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, একটি শিশুরও আত্মসম্মান আছে। ধরা যাক, যে বাবা এত বছরেও খোঁজ করেননি, এখন জন্মসনদের জন্য ‘ঠেকায়’ পড়েছে বলে শিশুটিকে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে? রাষ্ট্র ও সরকার জনগণবান্ধব হলে আইনে এমন অসংগতি থাকার কথা নয়।