মাতৃভাষা পালন দেশে দেশে

প্রভাতফেরি, ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পার্ঘ্য, আলোচনার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশনগুলো শুক্রবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে গান, যন্ত্রানুষঙ্গ, মাতৃভাষা দিবসের প্রতিযোগিতার চিত্রাঙ্কন, কবিতা ও রচনায় বিজয়ীদের প্রদর্শনী আর আলোচনার মধ্য দিয়ে ভিন্ন আবহে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের উপস্থিতিতে কলম্বোর ইনডিপেনডেন্ট স্কয়ার মেমোরিয়াল হল হয়ে উঠেছিল ভাষার পালনের কেন্দ্র।

সকালে কলম্বোর ঐতিহাসিক স্বাধীনতা চত্বরে শ্রীলঙ্কা সরকার ও বাংলাদেশ হাইকমিশন যৌথভাবে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রায় সাড়ে তিন শ শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও দেশটির শিক্ষামন্ত্রী বান্দুলা গুনাওয়ার্দানে এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি এল পিরেস উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. রিয়াজ হামিদুল্লাহ চার বছর ধরে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-মতের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি বিকাশে ওই অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ হাইকমিশন দুই মাস ধরে শ্রীলঙ্কাজুড়ে চিত্রাঙ্কন, কবিতা ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ওই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৩৯ জনকে পুরস্কৃত করেন। কলম্বোর ইনডিপেনডেন্ট স্কয়ার মেমোরিয়াল হলে ওই অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার একটি কয়ার গ্রুপ যন্ত্রসংগীতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এবং পণ্ডিত অমরাদেবার গান পরিবেশন করেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় পর্বে মালদ্বীপ, রাশিয়া, ভারত, ফ্রান্স ও চীনের নাগরিকেরা গান এবং যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের যৌথ উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে কনস্যুলেট জেনারেল মিলনায়তনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে বায়ান্নর ভাষাশহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমার নেতৃত্বে স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপর নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেল মিজ সাদিয়া ফয়জুননেসার নেতৃত্বে কনস্যুলেট জেনারেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এরপর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষাশহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। পরে দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করে শোনানো হয়।

বাংলাদেশ হাইকমিশন ক্যানবেরার তেলোপিয়া পার্কে মানুকা সার্কিট ও নিউ সাউথ ওয়েলস স্ট্রিটের ক্রসরোডে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণে প্রভাতফেরি অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন এসিটি গভর্নমেন্টের জাস্টিস মিনিস্টার সেইন রেটেনবারি, বিরোধী দলের নেতা এলিস্টর কো ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পেরুর রাষ্ট্রদূত, বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী ও অভিবাসী এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার সুফিউর রহমান হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হাইকমিশনার সুফিউর রহমান জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া বাণী পাঠ করা হয়। নিজ নিজ ধর্মমত ও প্রথা অনুযায়ী ভাষাশহীদদের উদ্দেশে মৌন প্রার্থনা এবং তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দিবসটির প্রথম প্রহরের অনুষ্ঠান শেষ হয়। সন্ধ্যায় আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে শিশু–কিশোরসহ বাংলাদেশি শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রসিদ্ধ নৃত্যশিল্পী ওয়ারদা রিহাব ও তাঁর দল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন। যার উপজীব্য বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ।

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে রাত ১২টা ১ মিনিটে দূতাবাসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সেখানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপস্থিতিতে দূতাবাসে স্থাপিত অস্থায়ী শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে একুশের কর্মসূচির সূচনা করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী। এরপর ইয়াঙ্গুনে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন।

পরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দূতাবাসে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া বাণীগুলো পাঠ করেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা। ইয়াঙ্গুন প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।

জাপানের রাজধানী টোকিওর ইকেবুকুরো নিশিগুচি পার্কে অবস্থিত শহিদ মিনারবেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স শাহিদা আকতারের নেতৃত্বে দূতাবাসের সব কর্মকর্তা ও তোশিমা সিটির ভাইস মেয়র মাসাতো সাইতো পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং পরে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক ও অন্যান্য অতিথি প্রভাতফেরির মাধ্যমে শহিদ মিনারবেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান।

পরে টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রাঙ্গণে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন। এ সময় উপস্থিত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আগত অতিথিরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন।

পরে দূতাবাসের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে উপস্থিত দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শহিদ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করা হয়।