মাদকাসক্তের চিকিৎসা ‘ইচ্ছেমতো’

মাদককে না বলুন

পুরোনো একটি দোতলা বাড়িতে ব্রাদার্স মাদকাসক্তি, চিকিৎসা সহায়তা ও পরামর্শ কেন্দ্রের সাইনবোর্ড। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, রোগী আছেন ১১ জন। কোনো মনোচিকিৎসক, চিকিৎসক বা ওয়ার্ডবয় নেই। কেন্দ্রটির পরিচালক মো. ফয়সাল দাবি করলেন, ১০ শয্যার এই কেন্দ্রে চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু তিনি কাউকে হাজির করতে পারলেন না।

ব্রাদার্স মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটি রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরের উত্তর বিশিল এলাকায়। এভাবে ঢাকার অলিগলিতে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সেখানে নিয়মিত চিকিৎসক, মনোচিকিৎসক, ওয়ার্ডবয় বা নার্স থাকেন না। চিকিৎসায় মানা হয় না সরকারি নিয়মনীতি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিরাময় কেন্দ্রে রোগীকে মারধর, মানসিক নির্যাতন ও অপদস্থ করা নিয়মিত ঘটনা। শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশের চিত্রই মোটামুটি একই।

কয়েক বছর আগে মানিকগঞ্জে একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ছয় মাস ছিলেন মাহফুজুর রহমান, যিনি এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁকে প্রায়ই মারধর ও অপদস্থ করা হতো। একবার জোরে চড় মারায় মাসখানেক তাঁর কান দিয়ে পানি পড়ে ও পুঁজ বের হয়। তাঁর পায়ের পশম টেনে তুলে ফেলেছিলেন নিরাময় কেন্দ্রের কর্মীরা। এটাই নাকি চিকিৎসার নিয়ম।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে একেকজন একেক পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিচ্ছেন। কেউ আটকে রাখছেন, আবার কেউ মারধর করাটাকে চিকিৎসা বলছেন। এগুলো কোনো চিকিৎসা নয়।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

অবশ্য চিকিৎসার নিয়ম কী, তা বলা আছে সরকারি নির্দেশনায়। বলা হয়েছে, নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসার পর তাঁকে প্রশিক্ষিত লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাউকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তাঁকে বিশেষ কক্ষে রাখতে হবে। ওই কক্ষের মেঝে ও দেয়ালে ফোমজাতীয় পদার্থ থাকবে, যাতে রোগী পড়ে গিয়ে এবং কোনোভাবে মাথায় আঘাত না পান। মাদক গ্রহণ করতে না পারায় রোগীর শরীরে কাঁপুনি, মলমূত্র ত্যাগ করাসহ বিভিন্ন উপসর্গ ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ওষুধ দিতে হবে। মাদকাসক্তি ছাড়াতে রোগীকে কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে রাখতে হয়।

সারা দেশে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৬ লাখের বেশি। অবশ্য এই বিশালসংখ্যক মাদকাসক্তের চিকিৎসার জন্য দেশের ৪৪ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে মোটে ৩৫১টি। এর মধ্যে ১০৫টিই ঢাকায়। ২০ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো নিরাময় কেন্দ্রই নেই।

কিন্তু মাদকাসক্তের চিকিৎসা নেওয়া মাহফুজের মতো ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা বলছেন, মারধর ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ছাড়া তাঁরা কোনো চিকিৎসা দেখেননি। নির্যাতনের বিষয়টি সামনে আসে গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড অ্যান্ড সাইকিয়াট্রি ডি-অ্যাডিকশন হাসপাতালে মারধরের পর সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমের মৃত্যুর ঘটনায়। এরপর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ঢাকার ১১টি অবৈধ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়।

নিরাময় কেন্দ্রগুলো তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) মো. নুরুজ্জামান শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, একসময় যাঁরা মাদকাসক্ত ছিলেন, তাঁরাই এখন বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের মালিক। সেখানে চিকিৎসার নিয়মকানুন মানা হয় না। এসব কেন্দ্রে চিকিৎসাও ব্যয়বহুল।

কেন্দ্র কত, কী কী থাকতে হবে
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক গত বছর সারা দেশের ১৯ হাজার মাদকাসক্ত রোগীর মধ্যে এক জরিপ চালান। এ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৬ লাখের বেশি। অবশ্য এই বিশালসংখ্যক মাদকাসক্তের চিকিৎসার জন্য দেশের ৪৪ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে মোটে ৩৫১টি। এর মধ্যে ১০৫টিই ঢাকায়। ২০ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো নিরাময় কেন্দ্রই নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, অননুমোদিত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বৈধ সংখ্যার কয়েক গুণও হতে পারে, যার প্রকৃত সংখ্যা কারও জানা নেই। এর বাইরে সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে চারটি—ঢাকা, চট্টগ্রাম রাজশাহী ও খুলনায়।

অনুমোদনপ্রাপ্ত কেন্দ্রগুলোর মোট শয্যাসংখ্যা ৪ হাজার ৭২৮। চিকিৎসার অধিদপ্তরের কাজ হবে এসব নিরাময় কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে অনিয়ম দূর করা।

জন্য সরকারি ১০০ মনোরোগ বিশেষজ্ঞসহ দেশে আছেন মাত্র ২৭০ জন চিকিৎসক।

আইন অনুযায়ী, নিরাময় কেন্দ্রে একজন মাদকাসক্ত রোগীর জন্য গড়ে কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। এতে একজন চিকিৎসক (মেডিকেল অফিসার), একজন মনোচিকিৎসক, একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও জীবন রক্ষাকারী উপকরণ এবং ওষুধপথ্য থাকতে হবে।

বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে দুরবস্থার কথা কর্মকর্তারা একবাক্যে স্বীকার করেন। তবে সরকারি চারটি নিরাময় কেন্দ্রের অবস্থাও ভালো নয়। কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র তেজগাঁওয়ে শয্যাসংখ্যা মোটে ১২৪। কেন্দ্রটিতে চিফ কনসালট্যান্টসহ ২৬টি চিকিৎসকের পদ থাকলেও রয়েছেন ৮ জন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের পদ ফাঁকা।

চিকিৎসক পাওয়া যায়নি
ঢাকায় তিনটি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে চিকিৎসক, মনোরোগ চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল খুঁজে পাওয়া যায়নি। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসহীন ছোট কক্ষে বেশি রোগী রাখাসহ নানা অনিয়মও চোখে পড়ে।

মিরপুর ২ নম্বরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের পেছনে বড়বাগের একটি ঘুপচি গলিতে পুরোনো একটি বাড়ির নিচতলা ও দোতলায় ‘জয় মাদকাসক্তি, চিকিৎসা ও সহায়তা কেন্দ্র’। গিয়ে দেখা গেল, হাসপাতালের দোতলার একটি কক্ষের মেঝেতে পাতা ফোমে চারজন শুয়ে আছেন। পাশের আরেকটি কক্ষে কয়েকটি লোহার খাট। একটি খাটে দুজন রোগী শুয়ে আছেন। কেন্দ্রটির পরিচালক নজরুল ইসলাম দাবি করেন, ১০ শয্যার এই কেন্দ্রে একজন চিকিৎসক ও একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। তবে তাঁদের কাউকেই হাজির করতে পারেননি তিনি। যেমনটা ঘটেছিল মিরপুরের ব্রাদার্স মাদকাসক্তি কেন্দ্রেও।

কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন কল্যাণ মানসিক হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার অনুমোদনপ্রাপ্ত, তবে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চালানোর অনুমোদন নেই। কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপক মো. ফোরকান বলেন, মাদকাসক্ত থেকে অনেকেই মানসিক রোগী হয়ে যান। তাঁদের এখানে ভর্তি করা হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে একেকজন একেক পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিচ্ছেন। কেউ আটকে রাখছেন, আবার কেউ মারধর করাটাকে চিকিৎসা বলছেন। এগুলো কোনো চিকিৎসা নয়।

সরকারি চার কেন্দ্রের দুরবস্থা
বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে দুরবস্থার কথা কর্মকর্তারা একবাক্যে স্বীকার করেন। তবে সরকারি চারটি নিরাময় কেন্দ্রের অবস্থাও ভালো নয়। কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র তেজগাঁওয়ে শয্যাসংখ্যা মোটে ১২৪। কেন্দ্রটিতে চিফ কনসালট্যান্টসহ ২৬টি চিকিৎসকের পদ থাকলেও রয়েছেন ৮ জন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের পদ ফাঁকা।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা হৃদ্‌রোগসহ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত কি না, তা নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে, ইসিজিসহ নানা পরীক্ষার দরকার হয়। কিন্তু এসব পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে। কেন্দ্রটিতে জরুরি বিভাগও নেই।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিফ কনসালট্যান্টের (পরিচালক) দায়িত্বে থাকা আবাসিক মানসিক রোগের চিকিৎসক (আরপি-সাইকিয়াট্রিস্ট) কাজী লুৎফুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, নিরাময় কেন্দ্রে ২৮ দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া জরুরি। কারণ, এ সময় মাদকের উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু পুনর্বাসন কেন্দ্র না থাকায় অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে বাড়ি ফিরে যেতে হয়। তিনি বলেন, এমনও দেখা গেছে, সেখান থেকে মাদকাসক্ত হয়ে আবার কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ফিরে এসেছেন।

একসময় যাঁরা মাদকাসক্ত ছিলেন, তাঁরাই এখন বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের মালিক। সেখানে চিকিৎসার নিয়মকানুন মানা হয় না। এসব কেন্দ্রে চিকিৎসাও ব্যয়বহুল।
শরীফ নুরুজ্জামান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন)

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় একটি করে সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে। এই কেন্দ্রগুলো গত বছর ৫ শয্যা থেকে ২৫ শয্যায় উন্নীত করা হলেও সুবিধা তেমন বাড়েনি। লোকবলের অভাবে কোনো কেন্দ্রেই জরুরি বিভাগ চালু করা যায়নি। তিনটি কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা খুলনার। রাঁধুনির পদ না থাকায় এসব কেন্দ্রে রোগীর জন্য রান্নাও হচ্ছে না। খুলনা ও রাজশাহীর ২৫ শয্যার নিরাময় কেন্দ্র দুটি চলছে একজন চিকিৎসক দিয়ে। চট্টগ্রামের নিরাময় কেন্দ্রে আছেন দুজন চিকিৎসক।
চিকিৎসকেরা বলেছেন, মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ। এটা সমন্বিত চিকিৎসার বিষয়। অথচ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসাব্যবস্থা তত্ত্বাবধান করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. ফারুক আলম প্রথম আলোকে বলেন, মাদকাসক্তিও একটি মানসিক রোগ। দুটিরই চিকিৎসা দেন মানসিক চিকিৎসকেরা। সেই কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত ব্যবস্থা থাকতে হবে। তিনি বলেন, বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ