মামলা চলা অবস্থায় ঋণের সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ নয়

হাইকোর্ট ভবন
ফাইল ছবি

ঋণ পরিশোধ না করা সংক্রান্ত মামলা চলমান অবস্থায় ঋণের বিপরীতে ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দিতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্ত কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেই ঋণগ্রহীতা হলেন আব্বাস ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী আব্বাস। তিনি ২০১১ সালে কৃষি ব্যাংক থেকে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।

এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার রুলসহ আদেশ দেন। সুদ মওকুফ বিষয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৭৪০তম সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের নথি তলব করেছেন আদালত। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) ওই নথি দাখিল করতে বলা হয়েছে।

এর আগে ৫ মে ‘অবৈধভাবে বিএনপি নেতার ৪৮ কোটি টাকা সুদ মাফ’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটি যুক্ত করে ওই ঋণ নিয়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা ও মানি লন্ডারিংয়ে দুদকের মামলা থাকা অবস্থায় সুদ মওকুফের সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনিচুর রহমান গত সপ্তাহে ওই রিট করেন।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দু কুমার রায় শুনানিতে ছিলেন।

প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় এক দশক আগে ব্যবসার জন্য কৃষি ব্যাংক থেকে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের এক বিএনপি নেতা। ঋণ পরিশোধ না করায় দুই বছর পর অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়েছিল। ওই টাকায় নিজের ও স্ত্রীর নামে সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনও মামলা করে।

কিন্তু দুটি মামলার কোনোটি নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই কৃষি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই ঋণের প্রায় ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দিয়েছে। অবৈধভাবে এই সুদ মওকুফের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। কৃষি ব্যাংক সূত্র, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন এবং মামলার এজাহার সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

আদালতে প্রতিবেদনটি তুলে ধরে শুনানিতে আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, আন্দরকিল্লায় আব্বাস ট্রেডিংকে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য ঋণ দেওয়া হয় ২০১১ সালে। পণ্য এনে বিক্রির পর ঋণ পরিশোধের কথা থাকলেও ১০ বছরেও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেননি আব্বাস। নিজের ও স্ত্রীর নামে সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে এ টাকা রূপান্তর করা ও অর্থ পাচারের অভিযোগে ২০১৩ সালে কোতোয়ালি থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ মামলায় কারাগারে যান আব্বাস। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। মামলাটি এখন মহানগর বিশেষ আদালতে বিচারাধীন। একই অভিযোগে ওই বছর কৃষি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আব্বাসের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। সেই মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি।

প্রতিবেদন তুলে ধরে আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী আব্বাস ট্রেডিংকে ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি ৮৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয় কৃষি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা। অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দল অনুসন্ধান করে চলতি বছরের ২১ মার্চ প্রতিবেদন দিয়েছে।

আদালত বলেন, ব্যাংক যদি মনে করে তাঁর গ্রাহকের সুদ মাফ করে দেবে, ব্যাংক কি এটি পারবে না ? তখন চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক অর্ডার ১৯৭৩ অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এ টাকা জনগণের টাকা, সরকারকে দেওয়া হচ্ছে আইনের ধারা ৪ অনুযায়ী। যত মুনাফা হবে সরকারের ফান্ডে যাবে। টাকা নিয়ে কেউ খেলাপি করলে পিডিআর অ্যাক্টে মামলা হবে। এটি ব্যাংক কোম্পানিজ অ্যাক্ট দিয়ে হবে না।
আদালত বলেন, ‘একটি ব্যাংক যদি তার ঋণগ্রহীতাকে বলে, “তোমাকে মাফ করে দিলাম, মূল টাকা দিয়ে দাও।” এটি ব্যাংক পারবে না ? এ ধরনের সুদ মওকুফ নিয়ে মাঝেমধ্যে পত্রিকায় নিউজ দেখি।’

আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, ওই ঋণ নিয়ে তিনি (আব্বাস) মানি লন্ডারিং করায় দুদক তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এ টাকার জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা আছে। ওই অর্থ যদি উনি মানি লন্ডারিং করে থাকেন, তাহলে সেই টাকা কীভাবে মওকুফ করবেন?

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, যে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, তাতে জনস্বার্থ আছে। এরপর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দু কুমার রায় বলেন, মওকুফের ক্ষেত্রে যে অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট রেকর্ড এনে আদালত দেখতে পারেন।

শুনানি নিয়ে আদালত ওই রুলসহ আদেশ দেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।