মাসে কোটি টিকা দেওয়ার চিন্তা

টিকা নেওয়ার বয়সসীমা কমে ২৫ বছর। চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা আরও ৩০ লাখ টিকা এসেছে।

শ্যামলীর বাসিন্দা আবদুল মান্নানকে সকালে ভর্তি করা হয়েছিল রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। করোনায় আক্রান্ত মান্নানের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৭০-এ নেমে গেলে দুপুরে তাঁকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান স্বজনেরা। পরে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ছবি: সাজিদ হোসেন

সরকার টিকাদানে গতি বাড়াতে চায়। দ্রুত বেশি মানুষকে টিকা দিতে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতি মাসে ১ কোটি ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এই লক্ষ্যে ২৫ বছর পূর্ণ হওয়া দেশের যেকোনো নাগরিককে নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও চলবে টিকাদান।

কীভাবে টিকা কার্যক্রমকে জোরদার করে বেশি মানুষকে দ্রুত টিকার আওতায় আনা যায়, তা নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে একটি ভার্চ্যুয়াল সভা হয়েছে। সভায় যুক্ত থাকা তিনজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ৭ আগস্ট থেকে কীভাবে দেশব্যাপী করোনার টিকা দেওয়া হবে, তার কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, মাসে ১ কোটি বা তার বেশি ডোজ টিকা দেওয়া যায় কি না, তা আলোচনা হয়েছে। তবে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। কী হতে যাচ্ছে, তা খুব শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।

বয়স আরও কমল

সব মানুষের জন্য নিবন্ধনের বয়সসীমা আবারও কমিয়েছে সরকার। গতকাল থেকে ২৫ বছর পূর্ণ হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকেরা করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারছেন। শুরুতে এই বয়সসীমা ছিল ৫৫ বছর। এরপর পর্যায়ক্রমে ৪০, ৩৫ ও ৩০ বছর করা হয়েছিল।

অন্যদিকে করোনার সম্মুখসারির যোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা বয়স ১৮ বছর হলেই নিবন্ধন করতে পারবেন বলে গত সপ্তাহে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন। পর্যায়ক্রমে সব নাগরিকের জন্য বয়সসীমা কমিয়ে ১৮ বছর করার কথা জাতীয় করোনা টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনায় আছে। এভাবে সরকার জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনতে চায়। নতুন বয়সসীমায় গতকাল অনেকেই নিবন্ধন করেছেন। তরুণেরা প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী ও অভ্যস্ত। ধারণা করা হচ্ছে, নিবন্ধনের পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যাবে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার ৩৭৩।

ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা

৭ আগস্ট থেকে সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনার টিকা দেওয়া শুরু করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে টিকাকেন্দ্রের স্থান ঠিক করবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের মতো স্থানে টিকাকেন্দ্র হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক ডা. সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মোট সাড়ে চার হাজারের বেশি কেন্দ্র হবে। এ ছাড়া প্রতিটি পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে এবং সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে তিনটি করে টিকাকেন্দ্র করার পরিকল্পনা আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া চলবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বয়োজ্যেষ্ঠ ও নারীরা টিকা পাবেন।

টিকাদানের আগে টিকা গ্রহণে আগ্রহী সবার তথ্য লিখে রাখবেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। টিকাকেন্দ্রে নিবন্ধনের পর টিকা কার্ড দেওয়া হবে। এই কার্ড দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময় সঙ্গে আনতে হবে।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি ইউনিয়নে সপ্তাহে তিন দিন টিকা দেওয়া হবে। একটি কেন্দ্রে দুজন টিকাদানকারী ও তিনজন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করবেন। শেষ টিকা দেওয়ার পর এই দলটি কেন্দ্রে এক ঘণ্টা অবস্থান করবে। এই সময়ে তাঁরা নিবন্ধন-সম্পর্কিত তথ্য অনলাইনে তুলে রাখবেন। প্রতিদিনের প্রতিবেদন তৈরি করে নিজ নিজ উপজেলা বা পৌরসভায় পাঠাবেন।

গতকালের সভায় যুক্ত থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধন করেননি বা করতে পারেননি এমন ব্যক্তিরা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা নিতে পারবেন। অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিদের টিকা কার্যক্রমে যুক্ত করার কথাও ভাবা হচ্ছে। তাঁদের মূলত দুটি কাজে লাগানো হবে। প্রথমত তাঁরা টিকা নেওয়ার ব্যাপারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবেন। দ্বিতীয়ত টিকাকেন্দ্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারেও তাঁদের সহায়তা নেওয়া হবে। টিকা দেওয়ার আগে প্রতিটি এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে।

খুলনা ও কক্সবাজার জেলার দুটি উপজেলার দুজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা অধিদপ্তরের নির্দেশনা পেয়েছেন। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। এঁদের একজন বলেন, টিকার সরবরাহ থাকলে টিকা দেওয়ায় কোনো সমস্যা হবে না।

টিকা ও টিকাদানের গতি বাড়বে

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল রাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত তিনটি আলাদা ফ্লাইটে চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা ৩০ লাখ টিকা ঢাকায় পৌঁছেছে। এ ছাড়া আগামীকাল শনিবার জাপান থেকে ৮ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আসবে ঢাকায়। ৩ আগস্ট আরও ৬ লাখ টিকা পাঠাবে জাপান।

করোনা টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের আওতায় বাংলাদেশকে প্রায় ৩০ লাখ অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়ার কথা আছে জাপানের। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২ লাখ ৪৫ হাজার টিকা বাংলাদেশে এসেছে।

জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি মো. মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে জানান, কোভ্যাক্সের আওতায় ফাইজারের ৬০ লাখ টিকা সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। তবে দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কোভ্যাক্সের আওতায় চীনের সিনোফার্ম বাংলাদেশকে ৩০ লাখ টিকা দিচ্ছে।

বাংলাদেশ এ পর্যন্ত উপহার ও কেনা মিলিয়ে মোট টিকা পেয়েছে ২ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার ডোজ।

টিকাদানের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক লিয়াকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদানের উদ্যোগ খুবই আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। টিকা সংরক্ষণাগার থেকে বের করলে তা ব্যবহার করে ফেলতে হবে। সুতরাং যে পরিমাণ টিকা কেন্দ্রে নেওয়া হবে, তা দিয়ে ফেলতে হবে। এ জন্য টিকাকেন্দ্রে মানুষ আসা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এ জন্য জোর পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি দরকার হবে। জনসম্পৃক্ততা ছাড়া এসব কাজ সুচারুভাবে করা সম্ভব না-ও হতে পারে।’