মাস্ক ও গ্লাভস–সংকটে স্বাস্থ্যের মাঠকর্মীরা

প্রতীকী ছবি
মাঠপর্যায়ে মাস্ক ও গ্লাভসের সংকটের কথা আমরা জানি। স্থানীয় পর্যায়ে কেনার উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে সমস্যা সমাধানেরও চেষ্টা চলছে।
মো. শামসুল হক, পরিচালক, মাতৃ, কিশোর ও শিশু কর্মসূচি

মাঠপর্যায়ে মাস্ক ও গ্লাভসের সংকট চলছে। এক মাসের বেশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও টিকা কর্মসূচির কর্মীদের মাস্ক ও গ্লাভস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির পাশাপাশি মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে।

অন্যদিকে বিমানবন্দরে ৫০ হাজার ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) ও ৪৫০ পালস অক্সিমিটার যন্ত্র আটকে আছে এক মাসের বেশি। সেগুলো ছাড়িয়ে আনার উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জবাবদিহির ঘাটতির কারণে পিপিই, মাস্ক ও গ্লাভস নিয়ে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।

মহামারির শুরু থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নেতারা। আবার মহামারির কারণে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও টিকা কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর টিকা কর্মসূচি সচল করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

মাতৃ, কিশোর ও শিশু কর্মসূচির পরিচালক মো. শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে মাস্ক ও গ্লাভসের সংকটের কথা আমরা জানি। স্থানীয় পর্যায়ে কেনার উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে সমস্যা সমাধানেরও চেষ্টা চলছে।’

মহামারির শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে পিপিইসহ চিকিৎসাসামগ্রী কিনতে থাকে। একপর্যায়ে কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালকের পদসহ বেশ কিছু পদে পরিবর্তন আসে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে দরপত্র পদ্ধতিতে ফেরত আসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগার।

সরকার পিপিইসহ অন্যান্য সামগ্রীর হিসাব দেওয়া বন্ধ করেছে। নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে এবং প্রতিদিনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পিপিইসহ বিভিন্ন সামগ্রীর হিসাব দিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন সংগ্রহ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ ও মজুতের হিসাব তাতে থাকত। দুই সপ্তাহ ধরে সেই হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল বুধবারও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনাকালে সম্মুখসারির যোদ্ধা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকে তাঁদের সুরক্ষার কথা বলে আসছে। আর এখন জানা যাচ্ছে, তাঁদের মাস্ক-গ্লাভস নেই। এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত উদাহরণ।

মাঠ পরিস্থিতি

মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে স্বাস্থ্যসেবা দেন স্বাস্থ্য সহকারী ও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি)। সারা দেশে স্বাস্থ্য সহকারী আছেন ২৬ হাজার আর ১৪ হাজার আছেন সিএইচসিপি। তাঁরা টিকা দেন, প্রসবপূর্ব ও প্রসবকালীন সেবা দেন। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা দেন। এলাকার রোগ-ব্যাধির পরিস্থিতি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়মিত অবহিত করাও তাঁদের কাজ।

মাঠকর্মীরা নিজেরা মাস্ক, গ্লাভস কিনে ব্যবহার করছেন। যে কিনবে না, তাকে বলেছি সে যেন ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিতে না যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা, ময়মনসিংহ জেলা

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুলনার একটি উপজেলার একজন স্বাস্থ্য সহকারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা বিদেশ থেকে কোনো লোক এলে তাদের খোঁজখবর বা অবস্থান জানানোর দায়িত্ব আমাদের। মার্চ মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শুধু একটি সার্জিক্যাল মাস্ক দিয়েছিলেন। গ্লাভস বা পিপিই আমরা পাইনি।’ একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি। তাঁরা দুজনই বলেছেন, তাঁরা পকেটের টাকা খরচ করে মাস্ক কিনে ব্যবহার করছেন। তবে দুজনের কেউ গ্লাভস ব্যবহার করেন না।

এসব মাঠকর্মী জানিয়েছেন, মায়ের কোলে থাকা শিশুকে খুব কাছে গিয়ে টিকা দিতে হয়। এ সময় মাস্ক বা গ্লাভস না থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মুখে মাস্ক না থাকলে মায়েরা বিরক্ত হন, শিশুকে টিকা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।

ময়মনসিংহ জেলার একটি উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলেন, ‘মাঠকর্মীরা নিজেরা মাস্ক, গ্লাভস কিনে ব্যবহার করছেন। যে কিনবে না, তাকে বলেছি সে যেন ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিতে না যায়।’

খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী মো. আবদুল হামিদ গাজী সুন্দরবন-সংলগ্ন গ্রাম সুতারখালী এলাকায় টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দুটি পিপিই, এক সেট গ্লাভস এবং দুটি সার্জিক্যাল মাস্ক পেয়েছি। জীবনের তাগিদে ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে নিজের পকেট থেকে মাস্ক, গ্লাভস কিনে ব্যবহার করছি। প্রত্যন্ত এলাকায় এগুলো সংগ্রহ করাটাও খুব ঝক্কির।’

জানতে চাইলে দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সরবরাহ কিছুটা কম আছে। প্রতিদিন প্রচুর সুরক্ষাসামগ্রী হাসপাতালেই খরচ হয়ে যায়। স্বাস্থ্য সহকারী ও সিএইচসিপিদের আমরা সুরক্ষাসামগ্রী দিয়েছি, তবে সেটা কম।’

বিমানবন্দরে পিপিই ও যন্ত্র

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দাতাদের সূত্র জানিয়েছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫০ হাজার ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) পড়ে আছে প্রায় এক মাস ধরে। করোনা মোকাবিলার জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের অর্থে এই পিপিই এনেছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর পরিশোধ করে এসব পিপিই ছাড় করাচ্ছে না।

এ ছাড়া রক্তনালির স্পন্দন ও রক্তে দ্রবীভূত অক্সিজেন মাপার যন্ত্র পালস অক্সিমিটারও একই বিমানবন্দরে পড়ে আছে এক মাসের বেশি। বিশ্বব্যাংকের একই প্রকল্পের টাকায় ৪৫০টি যন্ত্র ইউরোপ থেকে এনেছে ইউনিসেফ। বাজারে পাওয়া যায়, এমন যন্ত্রের চেয়ে এগুলোর দাম প্রায় ১০ গুণ বেশি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, মহামারির শুরুতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে চিকিৎসা ও সুরক্ষাসামগ্রী কেনার কারণে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। এখন টেন্ডার পদ্ধতিতে কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে, এতে কিছু সময়ের প্রয়োজন। তবে স্থানীয় উদ্যোগে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে। ট্যাক্স ও ভ্যাটের জটিলতা নিরসন করে বিমানবন্দরে আটকে থাকা সামগ্রী দ্রুত ছাড়িয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

করোনাকালে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য

মহামারির বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাতৃস্বাস্থ্যের ওপর। দেশে প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা কমে গেছে। বাড়িতে প্রসব বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এতে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল এক পর্যালোচনায় দেখেছেন, গত বছর মার্চে একবার প্রসব-পূর্ব সেবা পাওয়া গর্ভবতী ছিলেন ৪২ হাজার ৫২৬ জন। এ বছর মার্চে সেই সংখ্যা কমে হয় ৩৬ হাজার ৪১৫। পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় এপ্রিলে। গত বছর এপ্রিলে একবার প্রসব-পূর্ব সেবা পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ৫৭১ জন। এ বছর ১৮ হাজার ৬২ জন।

অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, শিশুদের নিয়মিত টিকাদানের হার ১০ শতাংশ কমে গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও মাস্ক পরার কথা বলছে। অথচ প্রয়োজনের সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্ক-গ্লাভস দিচ্ছে না সরকার। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য।