মায়ের কাছে সন্তানের জীবনই আগে: ছেলেকে কিডনিদাতা মা
৫৪ বছর বয়সী বুলি বেগম ২৪ বছর বয়সী ছেলে জাহিদ হাসানকে তাঁর একটি কিডনি দিয়েছেন। মায়ের দেওয়া কিডনি ছেলের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই মা ও ছেলে এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতাসহ শারীরিক জটিলতা থাকলেও তাঁরা হাসিমুখে নিশ্চিন্ত মনে দিন কাটাচ্ছেন।
রংপুর ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ির পর গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর শ্যামলীতে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে (সিকেডি) ভর্তি হন জাহিদ। কিডনি প্রতিস্থাপনের আইনি বিষয় সুরাহার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব প্রক্রিয়া শেষে গত ২২ জানুয়ারি রাতে মা ও ছেলের অস্ত্রোপচার হয়।
বুলি বেগম হাসপাতাল ছেড়েছেন অস্ত্রোপচারের সাত দিনের মাথায়। আর জাহিদ হাসপাতাল ছেড়েছেন ১০ দিনের মাথায়। রাজধানীর শ্যামলীতে ভাড়া বাসায় অস্ত্রোপচারের পর মা ও ছেলের প্রথম দেখা হয়। সিকেডি হাসপাতালে মা ও ছেলে ছিলেন আলাদা দুই ভবনে, ফলে সেখানে দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে জাহিদ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন। অস্ত্রোপচারের পর তখনই হয় মা ও ছেলের প্রথম দেখা। সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে জাহিদের বড় বোন নূর নাহার মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, মায়ের চেহারা দেখে মনে হলো তিনি প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছেন। জাহিদও বারবার মা ভালো আছেন কি না, তা জানতে চাচ্ছিল। হাসপাতাল ছাড়ার আগে চিকিৎসকেরাও জানিয়েছেন, মা ও ছেলে সার্বিকভাবে ভালো আছেন।
পঞ্চগড়ের ছেলে জাহিদ হাসান রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেছেন। স্নাতকোত্তরে ভর্তির আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
গত ২৫ জানুয়ারি সিকেডি হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় জাহিদ হাসানের মা বুলি বেগমের সঙ্গে। হাসপাতালের কেবিনে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন তিনি। তখন হাসপাতালের অন্য আরেকটি ভবনে জাহিদ ছিলেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। কিডনি দান করতে এত কষ্ট হবে তা আগে জানা ছিল কি না জানতে চাইলে এই মা বলেন, কষ্ট হবে তবে এত কষ্ট হবে তা জানা ছিল না।
এই কষ্টের কথা জানলে ছেলেকে কিডনি দিতেন কি না জানতে চাইলে যন্ত্রণাকাতর মায়ের ঠোঁটে ফুটে ওঠে হাসির রেখা। বলেন, ‘আগে জানলেও দিতাম। মায়ের কাছে সন্তানের জীবনই আগে। সন্তানের জীবন বাঁচানো মায়ের জন্য ফরজ।’
বুলি বেগমের কাছে প্রশ্ন ছিল—আপনার প্রয়োজন হলে ছেলেমেয়েরা কি কিডনি দান করতেন? একটু সময় চুপ করে থেকে বুলি বেগম বললেন, ‘তারাও দিত।’ পাশে থাকা বড় মেয়ে নূর নাহারকে দেখিয়ে বলেন, আর কেউ না দিলেও এই মেয়ে দিত।
অস্ত্রোপচারের পর কিছুটা জ্ঞান আছে, এমন অবস্থায় মা জানতে চেয়েছেন ছেলে ভালো আছে কি না। ‘আমার পাগল কেমন আছে?’ প্রশ্ন ছিল তাঁর। চিকিৎসক যখন থেকে কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা বলেছেন, তখন থেকে মা বলেছেন কিডনি দিতে হলে তিনিই দেবেন।
জাহিদ স্নাতক পাস করার পর পরিবারটি নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। তারপরই জাহিদের অসুস্থতা ধরা পড়ে। তাঁর দুটি কিডনি বিকল হয়ে যায়। কিডনি প্রতিস্থাপন করার বিকল্প কিছু ছিল না। জাহিদের মা কিডনি না দিলে ভোগান্তি আরও বাড়ত। কিডনি ফাউন্ডেশনের চিকিৎসক শেখ মইনুল খোকন তাঁর অভিজ্ঞতায় বলেন, কিডনি দানের ক্ষেত্রে নারীরাই এগিয়ে আছেন। বাবা-ভাইয়ের তুলনায় মা ও বোনেরাই কিডনি দানে এগিয়ে আসেন বেশি।
জাহিদের তিন বোন ছিল। ২০০৪ সালে ১৮ বছর বয়সে এক বোন ব্লাড ক্যানসারে মারা যান। তখন বোনের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদেরও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয় মাস থাকতে হয়েছিল। আর একই বছরের নভেম্বর মাসেই মারা যান জাহিদের বাবা। তিনি ঘুমের মধ্যে হঠাৎ মারা যান। বাবা ছিলেন হানিফ পরিবহনের বাসচালক। সেই অর্থে ২০০৪ সাল থেকেই পরিবারটি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।
গত বছরের ১৭ অক্টোবর পরিবার জানতে পারে, জাহিদের দুটি কিডনিই কাজ করছে না। ২০১৯ সালেও একবার জাহিদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়েছিল। তখন রংপুরে যে চিকিৎসককে দেখেছিলেন, তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেননি বা অন্য কোথাও রেফার করেননি। এবার যখন জাহিদের শরীর খারাপ হয়, তখন একেবারে শেষ ধাপ, তখন আর করার তেমন কিছু ছিল না। ১৭ অক্টোবরের পর ১৫ দিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন জাহিদ। ডক্টরস ক্লিনিক নামের একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে গেলে তা–ও বিফল হয়। এর আগে ক্যাথেটারের মাধ্যমে চারটি ডায়ালাইসিস করা হয়েছিল। জাহিদের জ্বর ছিল। খাবার খেলেই বমি করে দিতেন।
চিকিৎসার জন্য পৈতৃক ভিটা বিক্রি
নূর নাহার বলেন, তাঁর ভাই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর তাঁদের যে আনন্দ হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেবেছিলাম, ভাইকে বাঁচানো যাবে না। এখন আমি আমার ভাইকে স্পর্শ করতে পারছি। ভাই চোখের সামনে, সুস্থ জীবনের পথে হাঁটছে—তার যে অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২০ সালে জন্ম ও মৃত্যুসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিবিএসের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছেন, তার প্রায় তিন গুণ মানুষ মারা গেছেন ২০২০ সালে।
২০২০ সালের মার্চে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে কিডনি–সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৮ হাজার ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে মারা যান ১০ হাজার ৬২২ জন।
সিকেডি হাসপাতালের প্যাকেজে মা ও ছেলের অস্ত্রোপচার, ১১ দিন হাসপাতালে থাকা বাবদ খরচ হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। তবে বিভিন্ন পরীক্ষা ও ওষুধ বাবদ এ পর্যন্ত হাসপাতালে খরচ হয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকা।
নূর নাহার জানান, এই টাকা জোগাড়ের জন্য তাঁর ১০ শতাংশ জমি এবং জাহিদদের পৈতৃক ভিটা বিক্রি করতে হয়। ওয়ারিশদের অনুমতির বিষয় আছে বলে বাইরের কারও কাছে জমি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। তাই কম মূল্যে আত্মীয়ের কাছে বিক্রি করতে হয়েছে। ওই আত্মীয় নিজেই অসুস্থ থাকায় জমি বিক্রির সব টাকা হাতে পাওয়া যায়নি।
জাহিদের চিকিৎসার জন্য শ্যামলীতে আরেক পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন বড় বোন নূর নাহার। হাসপাতাল থেকে ফেরার পরও মা ও ছেলেকে আলাদা টয়লেটসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রাখতে হবে। তাই এই বাসা ভাড়া নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
নূর নাহার ঢাকায় সরকারি চাকরি করেন। জাহিদের পড়াশোনার খরচ এই বোন দিতেন। তাঁর নিজস্ব একটি জমির ফসল দিয়েই পঞ্চগড়ে মায়ের খরচ চলত। জাহিদের আরেক বোনের বিয়ে হয়েছে। জাহিদের বড় ভাইয়ের তিন সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তবে পৈতৃক ভিটা বিক্রিতে কোনো দ্বিমত করেননি ওই ভাই। এক খালাতো ভাইও টাকা এবং কায়িক শ্রম দিয়ে সার্বক্ষণিক পাশে থাকছেন পরিবারটির।
সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন অনেকে
গত ১১ নভেম্বর প্রথম আলোতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদের ‘টাকার অভাবে মেধাবী জাহিদ কি মারা যাবে’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। ওই লেখা পড়ে দেশ ও দেশের বাইরের অনেকেই জাহিদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। প্রথম আলোতে লেখা প্রকাশের পর বিভিন্ন ব্যক্তি প্রায় সাত লাখ টাকা পাঠান জাহিদের চিকিৎসার জন্য।
তুহিন ওয়াদুদ বলেন, প্রথম আলোতে লেখার পর বেশ সাড়া পাওয়া যায়। এ ছাড়া জাহিদের বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সব সময় জাহিদের পাশে ছিলেন ও থাকবেন। জাহিদ ও তাঁর মায়ের দীর্ঘ মেয়াদে ফলোআপ লাগবে, তাই পরিবারটির পাশে থাকার চেষ্টা করবেন বলেও জানান এ অধ্যাপক।
জাহিদ ও তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নূর নাহার। তিনি বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এখন প্রতি মাসে জাহিদের শুধু ওষুধের পেছনে খরচ হবে ৩০ হাজার টাকা। জাহিদ ও তাঁর মায়ের ফলোআপ, খাওয়াদাওয়াসহ বেশ মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হবে। তবে এই মুহূর্তে তাঁদের হাতে যে টাকা আছে, তা দিয়ে কয়েক মাস চালাতে পারবেন।
শল্যচিকিৎসক মো. কামরুল ইসলাম এক হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। দেশে এ পর্যন্ত যত কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে, এর এক-তৃতীয়াংশ তাঁর হাত দিয়েই হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিকেডি হাসপাতালে তিনি নিজেই জাহিদ ও তাঁর মায়ের অস্ত্রোপচার করেছেন।
নূর নাহার সিকেডি হাসপাতাল, বিশেষ করে অধ্যাপক কামরুল ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশের মধ্যে এত কম খরচে আর কোথাও কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ পেতেন কি না, সন্দেহ আছে। পাশের দেশ ভারতে যেতে হলেও খরচ দ্বিগুণের বেশি হয়ে যেত।
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে চারটি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। প্রতিস্থাপনের পর বিকল হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। অর্থাৎ কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সাফল্যের হার ৯৬ শতাংশ। রোগী ও কিডনিদাতাকে নিয়ম মেনে ফলোআপ করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলেন এ চিকিৎসক।
কিডনি রোগ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রতিবছর মার্চের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার পালিত হয় বিশ্ব কিডনি দিবস। গত বছর কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘কিডনি রোগ নিয়েও সুস্থ থাকুন’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের দুটি কিডনি থাকে। জটিল ও দীর্ঘ দিন কিডনি রোগে ভুগলে মানুষের কিডনি অকেজো হয়ে যায়। তখন অন্যের শরীর থেকে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। অন্য দিকে একটি কিডনি নিয়েও মানুষ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারেন।
করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে মা ও ছেলে বাড়ি ফেরার পর তাঁদের আর দেখতে যাওয়া হয়নি। তবে গত ২৫ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় প্রতিবেদকের কাছে মা বুলি বেগম দোয়া চান। ছেলের জন্য একটু বেশি দোয়া করতে বলেন। সুস্থ হয়ে ছেলে বিসিএস ক্যাডার হবে, তখন এই ছেলে সংসারের হাল ধরবে—সেই প্রত্যাশা ছিল এই মায়ের।