মায়ের খালে মাছ ধরবেন ‘বাঘবিধবা’ মায়েরা

পাস পেয়েই মায়ের খালে মাছ ধরতে যান নারীরা।
ছবি: বন বিভাগ

অভাবী নারী বিধবা হলে এমনিতেই যন্ত্রণার শেষ নেই। আর ‘বাঘবিধবা’ হলে তো ষোলোকলা পূর্ণ হলো নরকবাসের। ধরাছোঁয়ার বাছবিচারের সঙ্গে যোগ হয় অপয়া, অলক্ষুনে তকমা।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরার ফাহিমা বেগম বলছিলেন, বিয়ের কয়েক মাস পরই তাঁর স্বামীকে বাঘে টেনে নিলে শ্বশুরবাড়ি থেকে শুরু করে বাপের বাড়ির মানুষ পর্যন্ত তাঁকে অপবাদ দিয়েছে। এমনকি নদীতে নামলে যেন কামটে টেনে নেয় এমন অভিশাপও দেওয়া হয়েছে।

সেই কুমির-কামট আর আপনজনদের মুখে ছাই দিয়ে ফাহিমা এখনো বেঁচে আছেন। মাছ ধরে, সেলাই করে কোনোমতে নিজের খাদ্য–বস্ত্র–বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। ফাহিমার সন্তান নেই বলে কিছুটা রক্ষা, কিন্তু যেসব নারীর ছোট ছোট সন্তান থাকতে বিধবা হতে হয়, তাঁদের অবস্থা সুন্দরবনঘেঁষা উপকূলে ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছের মতো। গোড়াটা মাটিতে প্রোথিত হলেও বাকিটুকু সমুদ্র বা কাদায়।

শনিবার এমন কয়েকজন বিধবা হঠাৎ যেন জানান দিলেন, তাঁরাও আছেন এই জনপদে। বাঘবিধবাদের নিয়ে যেসব করুণ গল্প আমরা বরাবর শুনে এসেছি, সেসব গল্প হয়তো একদিন একটু একটু করে বদলে যাবে। তারই এক ঝলক সূত্রপাত হলো সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের একটা ছোট্ট আয়োজনে।

কোবাদক ফরেস্ট অফিস সাতক্ষীরা রেঞ্জে হলেও ভৌগোলিকভাবে অবস্থান খুলনার কয়রা উপজেলায়। ২১ জন বিধবাকে দেওয়া হয়েছে বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট)। এই নারীরা আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্যে নৌকা চালাতে পারবেন। ২১ জনের মধ্যে ৫ জন নারী পেয়েছেন মাছ ধরার পাস।

স্বামীর মৃত্যুর পর গাবুরার ফাহিমাকে শুনতে হয়, তিনি অপয়া
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

আড়পাঙ্গাশিয়া দিয়ে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে ‘মায়ের খাল’ নামের এক জলাধার। সেই জলাধারে এখন এই নারীরা মাছ ধরতে পারবেন বৈধ পাস নিয়ে। এ খালকে স্থানীয় লোকজন কিছুদিন আগেও ডাকত সন্ন্যাসী খাল নামে। কিন্তু এখানে নারীরাই বেশি মাছ-কাঁকড়া ধরতে নামছেন বলে সম্প্রতি নাম বদলে রাখা হয়েছে মায়ের খাল।

এই মায়ের খালে বৈধভাবে মাছ আর কাঁকড়া শিকারে নামবেন ৫ বিধবা।
ছবি: বন বিভাগ

কয়রা উপজেলায় এখন বাঘবিধবার সংখ্যা শতাধিক। সত্যি এখনো এত মানুষের বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় কি না জানতে চেয়েছিলাম সাতক্ষীরার গাবুরার ফাহিমার কাছে। ফাহিমা প্রথম আলোকে জানালেন, গাবুরার চকবারার গাজীপাড়াতেই বাঘবিধবার সংখ্যা ৩৭। চৈত্র মাস হলেই তাঁরা ভয়ে সন্ধ্যার পর জানালা-দরজা বন্ধ করে দেন।

পাশ থেকে তখন আরেকজন বললেন, এই তো এ বছরের মে মাসে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারানো মৌয়াল রেজাউল সর্দারের বাবা ইসমাইল সরদারও নিহত হয়েছেন বাঘের হামলাতেই। তিনি শুরু করলেন ২০১৪ সালের সে গল্প।

শনিবার নৌকা চালানোর পাস পাওয়ার মধ্যে কয়রার দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারা গ্রামের মনিরা খাতুন একজন। ছয় বছর আগে খাসিটানার দক্ষিণ দিকের বনে বাঘের আক্রমণে নিহত হন তাঁর স্বামী নজরুল ইসলাম। নজরুলের শ্বাসনালি ছিঁড়ে নিয়েছিল বাঘ। আর বেঁচে থাকা স্ত্রী মনিরার শ্বাসনালি বন্ধের উপক্রম করেছে মানুষের নানা কুসংস্কার। তিন সন্তান নিয়ে ছয় বছর ধরেই তিনি লড়াই চালিয়ে আসছেন। কখনো মাটি কেটে যা পান, তাই দিয়ে চাল কিনে আনেন। কখনো চুরি করে বনে প্রবেশ করেন। গাছের পাতা নড়ে উঠলেই ধরা পড়ার ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন গাছের আড়ালে।

কয়রার ফেলী দাসী আগামী বছরের জুন পর্যন্ত নৌকা চালানোর বৈধতা পেয়েছেন।
ছবি- বন বিভাগ

কোবাদক ফরেস্ট অফিস থেকে শনিবার পাস নিয়ে ফিরেছেন ঘণ্টা দেড়েক ট্রলারের পথ পাড়ি দিয়ে। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। শনিবার বৃষ্টি হচ্ছে সুন্দরবন এলাকায়। এ অঞ্চলে বৃষ্টি মানে পা ফেলার সুযোগ নেই। এমন সব অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যেও ৪০ বছর বয়সী মা মনিরা খাতুন মুঠোফোনে চিৎকার করে জানালেন, আজ তাঁর মন খুব ভালো। একা একা তো নৌকা নিয়ে যেতে পারবেন না। যাবেন বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু এই যে তিনি নৌকা বাওয়ার, মাছ-কাঁকড়া ধরার একজন বৈধ মাঝি, জেলে এটাই তাঁর বড় এক স্বীকৃতি।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার নিজ হাতে আজ তাঁকে বৈধতা দিয়েছেন। তবে তাঁদের অঞ্চলে মাছের চেয়ে কাঁকড়া ধরা বেশি লাভজনক। পাওয়া যায় বেশি। বাঘবিধবা মনিরা তাঁর নৌকা নিয়ে কাঁকড়া খুঁজবেন বৈধভাবে। কোস্টগার্ডের বাঁশি শুনে এখন আর ভয় পেয়ে পালাতে হবে না।

শনিবার পাস পাওয়া নারীদের সবার পরিবারের সদস্যসংখ্যা জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ থেকে জানাল, সবাইকেই নিজের সন্তানের খরচ চালাতে হয়। এ নারীরা তাঁদের বৃত্তান্ত ও ছবি জমা দিয়ে পাস নিয়েছেন।

মায়েদের হাতে পাস তুলে দেওয়ার আয়োজনটির উদ্যোগ সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসীন হোসেন জানালেন, এই দুস্থ নারীরা এত দিন বছরের বিভিন্ন সময় স্থানীয় মেম্বারদের তত্ত্বাবধানে রাস্তার মাটি কাটার কাজ করতেন। এখন নিজেরাই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করবেন।

আংটিহারার ‘বাঘবিধবা’ মনিরা নৌকায় নেবেন বড় ছেলেকে।
ছবি: বন বিভাগ

পশ্চিম বন বিভাগের এ আয়োজনে উপস্থিত কয়রার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মুন্ডাদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী আশিকুজ্জামান আশিক প্রথম আলোকে জানালেন, পাস পাওয়ার পরপরই ৫ নারী রওনা হন জাল নিয়ে মায়ের খালে মাছ ধরতে। জোয়ার এলেও বৃষ্টির জন্য ব্যাঘাত ঘটছিল। কিন্তু অসহায় এই নারীদের পাস পাওয়ার আনন্দের কাছে তুচ্ছ হয় বৃষ্টিবাদল। তেমন উচ্ছ্বাস আংটিহারার মনিরার কণ্ঠেও। তিনি অভিযোগের স্বরে বলছিলেন, ভোটার কার্ডে তাঁর নাম মনিরা বেগম, কিন্তু পাসের কাগজে কেন খাতুন লেখা, এটা বুঝতে পারছেন না। তাঁকে আমরা বোঝালাম, পদবি নিয়ে এত ভাবনার অবকাশ আসলে একটা কাগজের স্বীকৃতির কারণেই। ছয় বছর ধরে শুনে আসছিলেন অপয়া আর অলক্ষ্মী। এখন স্বয়ং বন বিভাগ থেকে ডেকে নিয়ে জঙ্গল (সুন্দরবননির্ভর জীবিকা) করার অনুমতি দেওয়ায় বেশ আত্মবিশ্বাস এসেছে এই বিধবার।

হয়তো বিপৎসংকুল পথে এই সামান্য উপার্জনের সুযোগে তেমন বিশেষ কিছুই বদলাবে না। তবে সমাজের চোখে নিজের সম্মানের স্বীকৃতি তাঁকে মানসিক শক্তি দেবে। এটুকু পুঁজি হয়ে রইল সুন্দরবনঘেঁষা উপকূলীয় জনপদের অবহেলিত ২১ নারীর জন্য।