মিতুকে আগেও একবার হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল

বাবুল আক্তার ও মাহমুদা খানম মিতু
ফাইল ছবি

মাহমুদা খানম যেদিন খুন হন এর মাসখানেক আগেও তাঁকে একবার হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তাঁর স্বামী বাবুল আক্তার তখন প্রশিক্ষণ নিতে চীনে ছিলেন। তবে খুনের ওই পরিকল্পনা তখন ‘সফল’ হয়নি। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

স্ত্রী মাহমুদা খানমকে (মিতু) হত্যার অভিযোগে করা মামলায় বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১২ মে রিমান্ডে নিয়েছে পিবিআই। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আজ সোমবার তাঁকে চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হয়েছে। পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রথম তিন দিনের জিজ্ঞাসাবাদে একরকম নিরুত্তরই ছিলেন বাবুল আক্তার। পরে কিছু কথা বলেছেন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত বোধ করছেন তিনি। কথা বলার সময় দু–একবার কেঁদেছেনও।

অবশ্য মাহমুদা হত্যার কারণ–সম্পর্কিত সব প্রশ্নই এড়িয়ে গেছেন বাদী থেকে প্রধান আসামি হয়ে যাওয়া সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তিনি শুধু এটুকু বলছেন, ‘সবই তো জানেন, আমি কী বলব।’


পাঁচ বছর আগে স্ত্রী মাহমুদা খানমকে হত্যার অভিযোগে শ্বশুরের করা মামলায় ১২ মে গ্রেপ্তার দেখানো হয় সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে। এর দুই দিন আগে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে তাঁকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে যায় পিবিআই। তাঁকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নতুন করে রিমান্ড আবেদন বা তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবেন কি না, এই প্রশ্নের জবাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সোমবারই (আজ) বলা যাবে।’

২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামে খুন হন মাহমুদা খানম। সেদিন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে উঠিয়ে দিতে বাসা থেকে বের হওয়ার পর চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড়ের কাছে তাঁকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তখন তাঁর স্বামী বাবুল আক্তার ছিলেন ঢাকায়। খুনের ঘটনার কয়েক দিন আগে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পান তিনি। এর আগে বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার ছিলেন। খুনের ঘটনার পর অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেছিলেন তিনি। এজাহারে উল্লেখ করেছিলেন জঙ্গিরা তাঁর স্ত্রীকে খুন করতে পারেন। কিন্তু কিছুদিন পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ওই বছরের ২৪ জুন রাতে ঢাকার গোয়েন্দা কার্যালয়ে তাঁকে প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর পুলিশের চাকরি থেকে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন বলে জানানো হয়।

বাদী থেকে যেভাবে প্রধান আসামি

মাহমুদা হত্যার পর তাঁর বাবা মোশাররফ হোসেন অবশ্য বাবুল আক্তারের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ তোলেননি। ২০১৭ সাল থেকে মেয়েকে হত্যার ঘটনায় বাবুল জড়িত বলে তিনি অভিযোগ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি বাবুলকে গ্রেপ্তারের দাবিও জানান।


ঘটনার শুরু থেকে বাবুল আক্তারের করা মামলাটি তদন্ত করে আসছিল চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। খুনের ১০ দিনের মাথায় এ মামলায় মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তাঁরা কামরুল শিকদার ওরফে মুছার (বাবুল আক্তারের সোর্স ছিলেন) নির্দেশে মাহমুদাকে খুন করার কথা স্বীকার করেন। ওয়াসিম ও আনোয়ার সম্পর্কে তখন পুলিশ জানায়, তারা ভাড়াটে খুনি। গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে থাকা ওয়াসিম ও আনোয়ারকে গতকাল নতুন মামলায় (মাহমুদার বাবার করা হত্যা মামলা) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।


মাহমুদা হত্যায় জড়িত সন্দেহে ২০১৬ সালে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন মুছার আরও দুই সহযোগী নুরুন্নবী ও নুরুল ইসলাম। আর ঘটনার পর থেকেই মুছা নিখোঁজ রয়েছেন। মুছার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে পুলিশ কর্মকর্তা মুছাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যান, তাঁকে তিনি চেনেন, তিনি এখনো বাহিনীতে আছেন। মুছাকে গুম করে, আবার তাঁকে ধরতেই ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পুলিশ।

মাহমুদা খুনের এত বছর পর যদি বাবুলকে গ্রেপ্তার করা যায় তাহলে মুছাকেও পুলিশ খুঁজে বের করতে পারবে বলে মনে করেন পান্না আক্তার। তিনি বলেন, ‘মুছা দোষী হলে তাঁকে আদালতে তোলা হোক, আমি তাঁকে জীবিত দেখতে চাই।’


গত বছরের জুন মাসে আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। পিবিআই কর্মকর্তারা আসামি ওয়াসিমকে গত ডিসেম্বরে কারা ফটকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পিবিআই জানায়, মাহমুদা হত্যায় অংশ নেওয়া ওয়াসিম ও আনোয়ারকে মুছার আত্মীয় কাজী আল মামুন ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এই সূত্র ধরে পিবিআই মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানান, সাইফুল হক নামে বাবুল আক্তারের এক ব্যবসায়িক অংশীদার বিকাশের মাধ্যমে ওই টাকা কয়েক ধাপে পাঠান।


সাইফুল ও মামুন দুজনই ১১ মে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাক্ষী (আগের মামলা) হিসেবে জবানবন্দি দেন। সেখানে সাইফুল বলেন, বাবুল তাঁকে ৩ লাখ টাকা মামুনকে দিতে বলেন। কথামতো বিকাশের মাধ্যমে টাকা দেন। পরে জানতে পারেন এই টাকা মাহমুদার হত্যাকারীদের দেওয়া হয়েছে। মামুনও জবানবন্দিতে বিষয়টি স্বীকার করেন।

১২ মে দুপুরে পিবিআই বাবুলের করা মামলায় আদালতে ৫৭৫ পাতার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, কাজী আল মামুন মুসার স্ত্রীর বোনের ছেলে। দুই সাক্ষীর জবানবন্দি ও তদন্তে বাদী বাবুল আক্তার বাদী থেকে আসামি হন।


চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর মাহমুদার বাবা মোশাররফ হোসেন পাঁচলাইশ থানায় বাবুলকে ১ নম্বর আসামি করে আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। ২ নম্বর আসামি করা হয় মুছাকে। এজাহারে বলা হয়, এনজিওতে কর্মরত এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বাবুল তাঁর মেয়েকে খুন করেন। খুনে নেতৃত্ব দেন মুছা। পরে এই মামলায় বাবুলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বাবুলকে ওই দিনই (১২ মে) আদালতে হাজির করে পিবিআই।


তবে বাবুল জড়িত নন বলে আদালতে দাবি করেন তাঁর আইনজীবী আরিফুর রহমান। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছর পর বাবুলকে জড়িত বলা রহস্যজনক। ন্যায়বিচারের জন্য তাঁরা উচ্চ আদালতে যাবেন।

নাতি–নাতনিদের নিজের জিম্মায় চান মাহমুদার বাবা

নাতি–নাতনিদের নিজের জিম্মায় নিতে আদালতে আবেদন করবেন বলে জানান মাহমুদা খানমের বাবা মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, তাঁর নাতিনাতনিদের নিয়ে বাবুলের বর্তমান স্ত্রী কুমিল্লায় চলে গেছেন বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। দ্রুত নাতি–নাতনির অভিভাবকত্ব চান তাঁরা।


অন্যদিকে বাবুল আক্তারের পরিবারের পক্ষ থেকেও তাঁর সন্তানদের জিম্মায় রাখার চেষ্টা রয়েছে বলে জানা গেছে। বাবুল আক্তারের ভাই মো. হাসিবুর রহমান বলেন, বাবুল–মিতুর দুই সন্তান তাঁদের জিম্মায় আছে। তারা কোথায় আছে, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে চাননি।


পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাবুল আক্তারের রিমান্ড শেষে তাঁর ছেলের সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তারা কথা বলবেন। কারণ, ওই ছেলে হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী।