মিয়ানমারকে মিথ্যাচার বন্ধ করতে বলল বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে উপযোগী পরিবেশ তৈরি না করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দায় চাপানোটা মিয়ানমারের নতুন কৌশল নয়। তবে এবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনের সময় রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্ভট এক দাবি করে বসেছে দেশটি। ন্যামের মন্ত্রিপর্যায়ের সম্মেলনে মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কিউ তিন বলেছেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুল লোকের ঢল নেমেছিল মিয়ানমারে।

গতকাল বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে দেশটিকে সতর্ক করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ বলেছে, মিয়ানমার সরকারের অবশ্যই বানানো প্রচারণা বন্ধ করে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা পূরণে মনোযোগী হওয়া উচিত। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে যে প্রতিবন্ধকতা আছে, তা দূর করতে মিয়ানমারকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে রাখাইনে যাওয়ার নতুন ওই তত্ত্ব মিয়ানমার এমন একসময় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এনেছে, যখন প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশ আলোচনায় বসেছে। সম্প্রতি ঢাকায় তিন দেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের কোথায় কী করা দরকার আর চীন কীভাবে দুই পক্ষকে সহযোগিতা করবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নেতৃত্বের বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দিয়ে চীন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। গত ২২ আগস্টের প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর দুই দেশকে নিয়ে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীন। বিশেষ করে রাখাইনের পরিবেশ নিয়ে রোহিঙ্গা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে আস্থা নেই, সেটা প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় দফা উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার পর স্পষ্ট হয়েছে। তাই প্রত্যাবাসনে মধ্যস্থতার হিসেবে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে তিন দেশের মন্ত্রীদের বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটি ঢাকায় বৈঠক করেছে। গত সপ্তাহে ঢাকায় তিন দেশের ওই বৈঠকে রাখাইনের পরিবেশ ফেরানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথে নতুন কাঁটা, সে বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন আছে। তাই রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ ফেরানোসহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগটি যেন শেষ পর্যন্ত কাজে আসে, সে ব্যাপারে চীনের জোর চেষ্টা চালানো উচিত বলে মনে করছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। কারণ, চীন এই প্রক্রিয়ায় সফল না হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশটির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

বাংলাদেশের প্রতিবাদ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কিউ তিন ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে ‘ধর্মীয় নিপীড়ন’, ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ ও ‘গণহত্যার’ মতো শব্দ ব্যবহার করে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিকে বাংলাদেশ ‘ভিন্নভাবে’ চিত্রায়িত করছে বলে অভিযোগ করেছেন।

বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের একাত্তরে রাখাইন যাওয়ার বিষয়টি খণ্ডন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ, তথ্যবিকৃতি এবং ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা ওই বক্তব্যকে বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করছে।’

এ মুহূর্তে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে সাড়ে ৭ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নতুন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার পর। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনের’ অভিযান হিসেবে অভিহিত করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার জন্য পুরোপুরিভাবে দায়ী যখন এ ধরনের অযৌক্তিক অভিযোগ তোলে তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরা এবং সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ তৈরির বিষয়টি

নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে বলেছে বাংলাদেশ। বহু বছর ধরে চলে আসা এ সংকটের সমাধান যাতে টেকসই হয়, সে জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করতে হবে মিয়ানমারকে।