মুক্তিযুদ্ধের সুফিয়া কামাল

সুফিয়া কামাল

জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন মহিলা পরিষদের সভানেত্রী। রাজপথে-জনপদে হেঁটে নারীমুক্তির মশাল প্রজ্বালনের পাশাপাশি দেশমাতৃকার মুক্তির গানও গেয়েছেন নির্ভীক কণ্ঠে। একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে ঢাকায় নারী সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে, ধানমন্ডির নিজ বাড়িতে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে, পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষর দান প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি তাঁর মুক্তিসংগ্রামী–সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা আবদুল কাহহার চৌধুরীকে হারিয়েছেন সুফিয়া কামাল, তবু শোকে মুষড়ে পড়েননি। অগ্নিস্নানে শুচি করতে চেয়েছেন একাত্তরে লাখ লাখ সন্তানহারা বাংলা মায়ের হৃদয়ের ক্ষত।

সুফিয়া কামালের সপ্তম কবিতাগ্রন্থ মোর যাদুদের সমাধি ’পরে এবং দিনলিপি একাত্তরের ডায়েরী ধারণ করে আছে অগ্নিঝরা একাত্তরে এক সংবেদী কবি ও সাহসী জননীর স্বর। কোমল কবিপ্রাণ বিক্ষুব্ধ নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠে হঠাৎ যেন, ‘তপ্ত রক্তে পথ রাঙায়ে ফাগুন দিন/ হয় এলোমেলো উথাল–পাথাল/ রাত্রির চোখ অশ্রুহীন’ (‘বাতাসে বারুদ’)।

সুফিয়া কামালের ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১ কালপর্বের দিনলিপি গ্রন্থিত হয়েছে একাত্তরের ডায়েরী শিরোনামে। কবির ব্যক্তিগত দিনপঞ্জির পাতা যেন তাঁর অজান্তেই রূপ পেয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সময়ের হৃদয়ছোঁয়া আখ্যানে, বিশ্বস্ত ইতিহাসে।

১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ বাংলার দুর্গত মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়ানোর কথা দিয়ে এ দিনপঞ্জির সূচনা। ৪ জানুয়ারি ১৯৭১-এর মমতামাখা লেখায় ফুটে উঠেছে বাংলার দুঃখী মানুষের করুণ মুখচ্ছবি: ‘হাজার হাজার মানুষ। সর্বহারা, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন। এককালে খেয়েদেয়ে চরের মানুষেরা স্বাস্থ্যবান ছিল। তাই আজও এরা মরণের সাথে যুজেও সবল।’

প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর মানবসৃষ্ট মরণখেলা যে দ্রুতই গোটা বাংলার মানুষের ওপর গণহত্যার কালরাত হয়ে নেমে আসে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলার পাশাপাশি প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী স্বদেশের অবয়ব খুঁজে পাওয়া যায় দিনলিপির একেকটি পৃষ্ঠায়।

১৬ মার্চ ১৯৭১ রাত ১০টায় কবি লিখছেন: ‘শিল্পী–সাহিত্যিক–কবিদের সভা শহীদ মিনার থেকে বায়তুল মোকাররম হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে মিছিল করে যাওয়া হল। অনেক মিছিল, অনেক সভা, অনেক জনতা, সবাই বেপরোয়া। মরণের মধুর স্বাদ এদের উন্মাদ করেছে। কোনো ভয়–ভীতি নেই।’

যেন ‘আঁধার সাগর দিলাম পাড়ি মরণ স্বপন দেখে’, যেন জীবনের জয়গানে মরণকে তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে চলা। গণমানুষ চলছে, কবিও চলছেন সে সংগ্রামের সাথি হয়ে।

একাত্তরের পয়লা বৈশাখও সুফিয়া কামালের দিনলিপিতে অক্ষয় হয়ে আছে, ‘আজ ১লা বৈশাখ। নববর্ষ, ১৩৭৮ সনের প্রথম দিন। প্রতি বৎসর ভোরে রমনার ফুল পাতা শোভিত বটের ছায়াতলে নববর্ষ উৎসবে অনুষ্ঠান হত। আজ সকালটা বিষণ্ন মলিন, রাতে বৃষ্টি হয়েছে। ভোর থেকে বোমা ফেলছে মধুপুর, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গঙ্গাসাগর, সমস্ত দেশব্যাপী। শয়তানীর সীমা আছে। গুটিয়ে আনতে হবে একদিন ওদের অত্যাচারের ফাঁদ। লাখ মানুষের জীবনদান ব্যর্থ হবে না, আজ নববর্ষে এ প্রার্থনা সর্বমানুষের অন্তর থেকে ধ্বনিত হচ্ছে।’

একাত্তরের এপ্রিলে ভুলভাবে সুফিয়া কামালের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে সবাই উদ্বিগ্ন হলেও পরে জানা যায় কবি বেঁচে আছেন, তবে ভগ্নিপ্রতিম কবি মেহেরুননেসার সপরিবার শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে সুফিয়া কামাল ২৯ এপ্রিলের দিনলিপিতে লিখছেন, ‘যদি আমার মৃত্যু দিয়েও কিছুমাত্র ভালো হত এ দেশের কি তৃপ্তি ছিল তার জন্য। যদি আমার মতো মেহেরুননেসার মৃত্যু সংবাদটাও মিথ্যা হতো!’

১৮ জুলাইয়ের বর্ষণসিক্ত দিনলিপি পাঠে মনে হতে থাকে, একাত্তরের শ্রাবণও ছিল রক্ত ও আগুনের কল্লোল।

রক্তের ঢল পেরিয়ে বাংলাদেশ অবশেষে পৌঁছে স্বাধীনতার গন্তব্যে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ কবি লিখে রাখছেন ঐতিহাসিক বিজয়ের গাথা। আর এর পরদিন ১৭ ডিসেম্বর শহীদ মিনারের বিজয় সমাবেশের বিবরণ দিচ্ছেন সে সভার সভাপতি সুফিয়া কামাল, ‘আজ আবার ৩টায় বোরহান (অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর) এসে নিয়ে গেল শহীদ মিনারে। নাগরিক সমিতিতে ভাষণ দিতে গেলাম। কি বল্লাম মনে নেই। দেখলাম, মেয়েরা, বোনেরা, মায়েরা, ভাইয়েরা অনেকে এসেছেন, অনেকে আজ আসেনি, অনেকে আর কোনো দিনই আসবেন না। তবু বাংলাদেশ স্বাধীন।’

স্বাধীনতার সাক্ষাৎ পেয়েও বাংলাদেশ তখন কাঁদছে স্বজন হারানোর শোকে। সে কান্নার ধ্বনি যেন অক্ষরে ঠাঁই নিয়েছে সুফিয়া কামালের ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর দিনপঞ্জিতে, ‘ভয়ানক, বীভৎস ভয়ঙ্কর শত্রুরা বাংলাদেশকে শোকাকুল, শোকাতুর, আতঙ্কিত, শঙ্কিত করে বদর বাহিনী হাজার হাজার লোককে এখন হত্যা করে চলেছে। মুনীর চৌধুরী, রফিক গিয়াস, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডা. রাব্বি, ডা. আজাদসহ আরও অনেক মহিলাসহ ২৪০ জনের দেহ এখন পাওয়া গেছে।...শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেনও নাকি নেই। এ কী শুনছি, দেখছি?’

দুঃখের রাত ফুরায় একসময়, ভোরের আলো ফোটে। কবিও কলম ধরেন নতুন করে। ২৯ ডিসেম্বর দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ করেন একটি কবিতা। শেষ পঙ্‌ক্তিতে বলেন, ‘এই মুছিলাম অশ্রুর ধারা দুঃখের হউক শেষ।’