মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিতে মুচলেকা

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পান, গেজেটেও নাম আছে। কিন্তু তারপরও ঢাকায় একাধিকবার আসতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দেওয়ার জন্য। সঙ্গে আনতে হচ্ছে তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এমন সাক্ষ্যদাতাকে। আর এভাবে প্রমাণ দিতে না পারলে সন্তান বা পোষ্যের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চিকিৎসকের চাকরি হবে না।

এ ঘটনা ঘটেছে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া ১২৪ প্রার্থীর ক্ষেত্রে। তাঁদের সঙ্গে চাকরি পাওয়া অন্যরা যোগ দিয়েছেন চার মাস আগে। কিন্তু এই ১২৪ জনের নিয়োগ আটকে আছে তাঁদের স্বজনদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে মাঠপর্যায় থেকে আপত্তি ওঠার কারণে।

এই পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মুচলেকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির জন্য তাঁদের প্রত্যয়ন দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়া গেলে চাকরি চলে যাবে। গত সোমবার ভুক্তভোগী প্রার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের শুনানি শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বিশেষ এই বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন ৪ হাজার ৭৯২ চিকিৎসক।

তবে গেজেটে নাম থাকা এবং নিয়মিত ভাতা পাওয়ার পরও এ ধরনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় আসা একাধিক মুক্তিযোদ্ধা। এ বিষয়ে দফায় দফায় শুনানি করায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রথম আলোকে বলেছেন, এ ধরনের মুচলেকা দিয়ে সন্তানদের চাকরি করা অপমানজনক। শুনানির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, যাচাই–বাছাই একটি গোপন বিষয়। এভাবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যাচাই করা অন্যায়।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, অধিকতর যাচাইয়ের প্রয়োজন ছিল বলেই তা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সবার সনদে যে সমস্যা রয়েছে, তা আমরা বলছি না, তবে কারও কারও ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে। তাই আমরা ঠিক করেছি, অভিযুক্তদের আমরা চূড়ান্ত প্রত্যয়ন দেব না। তাদের মুচলেকা দিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে হবে, যাতে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে।’

প্রসঙ্গত, এবারই শেষবারের মতো সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা পাচ্ছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদের প্রার্থীরা। সরকারের সিদ্ধান্তে ৪০তম বিসিএস থেকে কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে।

>

বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া ১২৪ প্রার্থীর অভিভাবককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ দিতে হচ্ছে।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সভাপতিত্বে প্রার্থী, তাঁদের অভিভাবক ও সাক্ষীদের শুনানি করা হয়। আজ বুধবার আবার আরেক দফা শুনানি হওয়ার কথা। এসব প্রার্থীকে যাচাই–বাছাইয়ে গত ১ অক্টোবর জামুকার সদস্য ও সাংসদ মোতাহার হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। সেই কমিটি এসব প্রার্থীকে প্রত্যয়ন দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। যদিও তা আমলে না নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী নিজেই শুনানি করার সিদ্ধান্ত নেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় ১২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থীর সনদের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্যয়ন চেয়েছিল। তাদের সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সুপারিশ রয়েছে। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপকমিটি গত ২২ অক্টোবর অভিভাবকদের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটির সুপারিশে দেখা গেছে, বেশির ভাগ প্রার্থীর ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে উল্লেখ করা হয়েছে, উপজেলা যাচাই–বাছাই কমিটি থেকে যেসব সুপারিশ এসেছে, তাতে অনেক মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে প্রশ্ন আছে।

গত সোমবার জামুকা কার্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানদের অনেকেই এভাবে শুনানির ঘটনায় বিরক্ত। মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম বাংলাদেশ ব্যাংকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি করার পর অবসরে গেছেন। নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন, গেজেটেও নাম রয়েছে। তাঁর এক সন্তান পুলিশে চাকরি করেন। আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এত দিন চাকরি করার পরও আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রমাণ দিতে হচ্ছে। এটা খুবই কষ্টের।’

ঢাকার তেজতুরী বাজার থেকে ইশরাক হোসেন এসেছেন চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। দুবার স্ট্রোক করেছেন। ইশরাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভাতা পাই, গেজেটে নাম আছে, তারপরও বারবার আমাকে জামুকা কার্যালয়ে আসতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমার অনেক কিছুই মনে থাকে না। এই বয়সে আমাকে কেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে হবে?’

খুলনা থেকে আসা মুন্সি আবদুর রশিদ ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর ছেলেমেয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধা কি না, সেই পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখের কিছু নেই।