মুক্তিযোদ্ধাদের বসতবাড়ি

সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা সোনা মিয়াকে এই বাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছে। বীর নিবাস নামের এ বাড়ির সামনে গাছের পরিচর্যা করছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মাহমুদাবাদ গ্রামে।  ছবি: আনিস মাহমুদ
সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা সোনা মিয়াকে এই বাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছে। বীর নিবাস নামের এ বাড়ির সামনে গাছের পরিচর্যা করছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মাহমুদাবাদ গ্রামে। ছবি: আনিস মাহমুদ

‘আগে আমরা হোগলাপাতার বেড়া ও খড়ের চালের কুঁড়েঘরে থাকতাম। ঝড়-বৃষ্টিতে অনেক কষ্ট হইত। শীতের দিনে ঠান্ডা বাতাস ঢুকত ঘরে। সরকারের উপহার পাইয়্যা আমরা খুব খুশি।’

বলছিলেন, পিরোজপুর সদর উপজেলার হোরের হাওলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান শেখের স্ত্রী ফুলবড়ু। হাবিবুর রহমান ১০ বছর আগে মারা যান। তিন সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছিলেন ফুলবড়ু। ছেলেমেয়েরা তখন অনেক ছোট। কোনো রকমে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে সংসার চলে। জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরের জায়গায় একটি পাকা বাড়ি তাঁর ভাসমান অবস্থার অবসান ঘটিয়েছে।

ফরিদপুরের ৭২ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা জুলমত খান দিনমজুর। পাটখড়ির বেড়ার ওপর টিনের ছাপরায় পরিবার নিয়ে বাস করতেন তিনি। স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, স্বামী ও তিন মেয়ে নিয়ে ছাপরায় থাকার কষ্টের দিনগুলো এখন তাঁদের কাছে দূর অতীত মনে হয়।

সারা দেশে ২ হাজার ৭২০ জন ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারকে পাকা বাসস্থান নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। ‘বীর নিবাস’ নামের একতলা এই বাড়িগুলোয় দুটি শয়নকক্ষ, একটি প্রশস্ত বারান্দা ও বাথরুম আছে। পতাকার রঙে লাল ও সবুজ রং করা ভবনগুলো দৃষ্টিনন্দন। শুধু আবাসিক ভবনই নয়, প্রতিটি বাড়িতে গরু, হাঁস, মুরগি পালনের জন্য শেড বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে একটি করে টিউবওয়েল।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় এ রকম ২ হাজার ৯৭১টি বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ফরিদপুর, গাজীপুর, পিরোজপুর, জামালপুর, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নওগাঁ, কক্সবাজারের শতাধিক বীর নিবাস ঘুরে দেখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, এই বাড়ি তাঁদের আবাসনের কষ্টই শুধু দূর করেনি, সামাজিক মর্যাদাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে কিছু কিছু ভবনের নির্মাণকাজে দুর্বলতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেউ কেউ প্রথম আলোর কাছে বলেছেন, নির্মাণের তিন-চার বছর না পেরোতেই অনেক বাড়ির দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। ছাদের অনেক স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে।

অন্যদিকে কিছু জায়গায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বাছাই ঠিকমতো হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। কোথাও কোথাও সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারাও বাড়ি পেয়েছেন। অনেকের স্বজন এসে সেসব বাড়িতে থাকছেন। কেউ কেউ এসব বাড়িতে তালা দিয়ে নিজের বাড়িতে থাকছেন, কেউবা ভাড়া দিয়েছেন।

শেষ বয়সে এসে স্বস্তি

শেষ বয়সে এসে স্বস্তি

কয়েকটি ভবনে ফাটল

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকটি বাসস্থানে ফাটল দেখা গেছে। জেলার ১৫টি বীর নিবাসের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা দরবেশ আলীর বাড়িতে গেলে তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ মিয়া বলেন, কয়েক বছরে দেয়ালের কয়েকটি জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। সুহিলপুর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ জানান, তাঁর বাড়িতে কাঠের দরজা বেঁকে গেছে। নিম্নমানের উপকরণের কারণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

একইভাবে নওগাঁর সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের দোগাছী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল আলমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছাদের অনেক
স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে। একই কথা জানান গাজীপুরের নীলেরপাড়া এলাকার বাসিন্দা ইয়াজ উদ্দিন শেখ।

সচ্ছল ব্যক্তিদের নামে বাড়ি

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার বীর আদিয়ারপাড় গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুর রশিদ জামালীর বাড়ির সব কক্ষে তালা লাগানো। তাঁর ভাতিজা মো. সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাকা (আবদুর রশিদ) মাঝেমধ্যে এসে থাকেন।’

মেলান্দহ পৌর শহরের আদিপুত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা আহসান হাবিবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সরকারের বানিয়ে দেওয়া বীর নিবাসে তিনি থাকেন না। সেটি ৪ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

বীর নিবাস পেয়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ধীরাশ্রম এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আলী। বাজারে তাঁর ১০টি দোকান আছে। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার জৈনসার ইউনিয়নের জৈনসার গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মো. সাজাহানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তাঁর নিজের বাড়ি, পুকুরসহ ১০ শতক পরিমাণ জমি আছে। চার ছেলের মধ্যে তিনজনই সরকারি চাকরি করেন।

প্রকল্পের নীতিমালায় বলা আছে, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বলতে বোঝাবে, যাঁদের ৮ শতাংশের বেশি জমি নেই এবং সংসারে আয় করতে সক্ষম সন্তান নেই। অথচ কক্সবাজারের মহেশখালীর মুক্তিযোদ্ধা সলিমুল্লাহর বড় ছেলে সাইফুদ্দিন সহকারী শিক্ষক, হাসানুল একটি কলেজের প্রভাষক ও উম্মে হাবিবা রামুর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত।

ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা লালের মোড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সুলতান উদ্দিন আহমেদ ৭ শতাংশ পৈতৃক জমি এবং ফরিদপুর সদরের ভাজনডাঙ্গা গুচ্ছগ্রাম-সংলগ্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলীর ১৩ শতাংশ জমি থাকার পরও তাঁরা এই বাসস্থান পেয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এসব বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭১ কোটি ১২ লাখ টাকা।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ফরিদপুর, গাজীপুর, পিরোজপুর, জামালপুর, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নওগাঁ ও কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি ও নিজস্ব প্রতিবেদকেরা)