মুছে যাবে বিদ্যালয়টি!

জরাজীর্ণ শ্রেণীকক্ষে চলছে পাঠদান  ।  ছবি: প্রথম আলো
জরাজীর্ণ শ্রেণীকক্ষে চলছে পাঠদান । ছবি: প্রথম আলো

বেইলি রোডে বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের ফটক পেরিয়ে একটু ভেতরে গিয়েই দেখা গেল জরাজীর্ণ ও ভাঙাচোরা দুটি কক্ষের একটি বাড়ি। বাড়ির দেয়াল পাকা হলেও পলেস্তারা উঠে পড়ছে। ওপরের টিনের ছাউনিও ভেঙে পড়ছে। শামিয়ানা (ত্রিপল) টানানো একটি কক্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছিলেন একজন নারী। এ দৃশ্য গত ৩ ফেব্রুয়ারির।
ভুতুড়ে পরিবেশের এই বাড়িটি আসলে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নাম সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পড়াচ্ছিলেন একজন শিক্ষিকা। ওই এলাকার (৫৩ নম্বর ওয়ার্ড) একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এটি। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই শ্রমজীবী ও গরিব পরিবারের সন্তান।
কিন্তু বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন চাইছে না এখানে বিদ্যালয়টি থাকুক। এর জেরে জায়গা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাসহ বেশ কিছু সমস্যার কারণে ৫২ বছরের পুরোনো এই বিদ্যালয়টি এখন বিলীন হওয়ার পথে। গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের জায়গায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। এ বিষয়ে করা মামলাতেও তারা জিতেছে। তাই বিদ্যালয়টি এখানে আর থাকতে পারবে না।
তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি এই বিদ্যালয়টি টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরা আপিল করবেন। এ রকম পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়টিতে উন্নয়ন না হওয়ায় এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পৌঁছছে। বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ ও শৌচাগারও নেই। গার্ল গাইড অ্যাসোসিয়েশনের ফটক পেরিয়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করতেও সমস্যায় পড়তে হয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এস এম আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই ওখানেই স্কুলটি থাকুক। কারণ, ওই ওয়ার্ডে আর কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এটি না থাকলে ওই এলাকার শ্রমজীবী ও গরিব পরিবারের শিশুদের পড়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এ জন্য আমরা বিদ্যালয়টি এখানে টিকিয়ে রাখার জন্য আপিল করব।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয়ের উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও গাইড হাউসের বাধার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও তারা কীভাবে একটি বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে, সেটি আমাদের অবাক করে।’
বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন ও বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৬২ সালে গাইড হাউস বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করলেও পরে ১৯৭৩ সালে অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিদ্যালয়টিও সরকারীকরণ করা হয়। এরপর বিদ্যালয়টি অধিগ্রহণ করা হয় এবং তখন থেকে সেটি প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
রমনা থানা শিক্ষা কর্মকর্তার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রথম দিকে কোনো সমস্যা না থাকলেও ১৯৮৯ সালে গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে এই বিদ্যালয়টি সরিয়ে নিতে অনুরোধ করা হয়। এভাবে আরও কয়েক বছর চলে যায়। কিন্তু তখন মন্ত্রণালয় মহাপরিচালককে জানিয়ে দেয় বিদ্যালয় স্থানান্তরের অবকাশ নেই। এর পরও স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হলে এলাকার গরিব ও শ্রমজীবী পরিবারের শিশুদের কথা বিবেচনা করে তা থেমে যায়। একপর্যায়ে বিষয়টি আদালতে গড়ায়।
বিভিন্ন ধরনের বাধাসহ নানামুখী সংকটে বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমছে। আগে কয়েক শ শিক্ষার্থী থাকলেও এখন মোট শিক্ষার্থী ৪৩ জন। যাদের প্রায় সবাই শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। শিক্ষকের সংখ্যা চারজন।
বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় কমিশনার সৈয়দা রেহানা ইমাম বলেন, ‘বিদ্যালয়টি একসময় আমরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলান। জায়গাও আমাদের। কিন্তু ১৯৭৩ সালে অনেকটা গোপনীয়ভাবে জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু গাইড হাউসের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ কাজের জন্য স্থানটি অপরিহার্য। এ ছাড়া বিদ্যালয়টির বর্তমান পরিবেশও শিশুদের জন্য অনুপযোগী। শিক্ষার্থীও কম। এ জন্য আমরা বিদ্যালয়টি অন্যত্র স্থানান্তর করতে বলছি। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে করা রিটের রায়ও আমাদের পক্ষে গেছে।’
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক রওশন আরা বেগম বলেন, স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে ওই এলাকার গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের পড়ার সুযোগ থাকবে না। এ জন্য তাঁরা আপিলের জন্য আদালতে যোগাযোগ করেছেন। তাঁর মতে, যেটুকু জায়গার মধ্যেই আছে, সেটুকু জায়গায় ভবন তৈরি করে বিদ্যালয়টি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।