মুনীরুজ্জামানের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি

পরিবার ও সুহৃদেরা যখন মুনীরুজ্জামানের আরোগ্য নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন, তখনই আকস্মিকভাবে গত ২৪ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।

খন্দকার মুনীরুজ্জামান

সত্যের প্রতি অবিচল, অকুণ্ঠচিত্তের সাহসী মানুষ ছিলেন খন্দকার মুনীরুজ্জামান। ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা ও লোভের সর্বগ্রাসী বিস্তারে সমাজে যখন মূল্যবোধের অবক্ষয় তীব্রতর হচ্ছে, তখন তাঁর মতো মানুষের চলে যাওয়ার শূন্যতা অপূরণীয় হয়ে ওঠে।

গতকাল সোমবার বিকেলে সাংবাদিক ও বাম রাজনীতিক খন্দকার মুনীরুজ্জামানকে নিয়ে জীবন নিবেদিত মুক্তির সংগ্রামে: মুনীরুজ্জামান স্মারকগ্রন্থ–এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আলোচকেরা এভাবেই তাঁর মূল্যায়ন করেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্মারক সংকলন সম্পাদনা পরিষদ। প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম।

দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বাম রাজনীতিক খন্দকার মুনীরুজ্জামান গত বছর ২০ আগস্ট করোনায় আক্রান্ত হন। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসায় তাঁর অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হচ্ছিল। আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছিল এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রাও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। পরিবার ও সুহৃদেরা যখন তাঁর আরোগ্য নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন, তখনই আকস্মিকভাবে ২৪ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

বক্তারা বলেন, গত শতকের ষাট দশকে সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবোধের চেতনার মেলবন্ধনে যে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তারই চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে। বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতির এই উজ্জ্বল সময়ের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন খন্দকার মুনীরুজ্জামান। এই স্মারকগ্রন্থে তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে দেশের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকেও লেখকেরা তুলে ধরেছেন।

খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিলেন সদাহাস্য অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুতে সাংবাদিকতার জগতে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।
মাহ্ফুজ আনাম, সম্পাদক, ডেইলি স্টার

প্রধান অতিথি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, মুনীরুজ্জামানের ভাবনার কেন্দ্র ছিল মানুষ ও মানবতা। তিনি তাঁর সারা জীবনে এই লক্ষ্যেই কাজ করেছেন। ষাটের দশকে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, শ্রমিক আন্দোলন করেছেন এবং নব্বই দশকে সমাজতন্ত্রের পতনের পরে তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছেন। তবে তাঁর লক্ষ্য ও আদর্শের পরিবর্তন হয়নি। শোষিত মানুষের মুক্তি ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর আদর্শ তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

অনুজেরা যখন চলে যান, তখন সেই বেদনা অসহনীয় হয়ে ওঠে বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারোয়ার আলী। তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক ও মানবমুক্তির যে আন্দোলন ষাটের দশকে শুরু হয়েছিল, মুনীরুজ্জামান তাতে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সেই স্বপ্ন তিনি কখনো ত্যাগ করেননি।

প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, বহুমুখী প্রতিভা ছিল মুনীরুজ্জামানের। সব কাজই তিনি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। সমাজতন্ত্রের পতনের পরে বাম ধারার রাজনীতির অনেকের পক্ষেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুনীরুজ্জামান খুব সহজেই সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে সফল হয়েছিলেন।

স্পষ্টভাষী ও নীতিনিষ্ঠ মানুষ মুনীরুজ্জামানের মানবিক মূল্যবোধ গভীর ছিল বলে উল্লেখ করেন বিচারপতি মমতাজউদ্দিন আহমদ।

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, মুনীরুজ্জামান ছিলেন সদাহাস্য অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুতে সাংবাদিকতার জগতে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কলেজজীবন থেকে শুরু করে আমৃত্যু মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর নিবিড় বন্ধুত্বের আবেগময় দীর্ঘ স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা যেমন প্রবল ছিল, তেমনি রাজনৈতিক তত্ত্বগত বিষয়েও গভীর ভাবনার অধিকারী ছিলেন। যখন যেখানে কাজ করেছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন।

আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক এম এম আকাশ, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, মুনীরুজ্জামানের বড় ভাই রফিকুজ্জামান, প্রকাশক মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ, সংবাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক কাজী রফিকুজ্জামান প্রমুখ। মুনীরুজ্জামানের স্ত্রী রুকাইয়া খাতুন সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সঞ্চালনা করেন দিলওয়ার হোসেন।

স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বাংলা ধরিত্রী। এতে রয়েছে ছয়টি পর্ব। পর্বগুলোতে রাজনৈতিক সহকর্মী, পেশাগত সহকর্মী, দেশ–বিদেশের বন্ধু ও সুহৃদেরা মুনীরুজ্জামান সম্পর্কে লিখেছেন। এ ছাড়া পরিবারের সঙ্গে তাঁর একান্ত সময় এবং তাঁর কিছু নির্বাচিত লেখাও রয়েছে বইটিতে।