মূলধারার গণমাধ্যমই শেষ ভরসা

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের পাঠক ও দর্শকের বেশ শক্ত একটা ভিত আছে। কিন্তু এই গণমাধ্যম সব বয়সের সব এলাকার মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমেছে। আছে নিয়ন্ত্রণমূলক আইন। খবরের খোঁজে মূলধারার পরিবর্তে বিকল্প মাধ্যমের প্রতি ঝুঁকছেন বড় সংখ্যক মানুষ। তবে গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সঠিক সংবাদের খোঁজে মূলধারার গণমাধ্যমই শেষ ভরসা। দরকার উদ্ভাবন শক্তিকে কাজে লাগানো ও কৌশলগত কিছু পরিবর্তন আনা।

এমন একটা প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কী, সে সম্পর্কে ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই) ও ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউট আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে ‘লিডারশিপ অর স্ট্যাগনেশন, দ্য ফিউচার অব মিডিয়া ভায়াবিলিটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন। ও উপলক্ষে আয়োজিত ওয়েবিনারে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক, বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধিরা কথা বলেন।

এমআরডিআই ও ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউটের পক্ষে গবেষণা করেছেন হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি রস সেটেলস। তাঁকে সহযোগিতা করেন সাংবাদিক তানিম আহমেদ। রস সেটেলস দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের পাঠক ও দর্শক আছেন। কিন্তু অঞ্চল ও বয়সভেদে খবর জানার উৎস আলাদা। শহরাঞ্চলে অল্প বয়স্করা অনলাইন ও টিভি দেখছে। বয়স্করা এখনো টিভি দেখেন ও খবরের কাগজ পড়েন। গ্রামাঞ্চলে তরুণদের কাছে খবরের মূল উৎস ফেসবুক। তারা টিভিও দেখছে। বয়স্করা টিভি দেখেন, স্থানীয় সংবাদপত্র পড়ে থাকে একটি ছোট অংশ।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমের প্রতি আগ্রহ কমতির দিকে। ২০১৯ সালে এমআরডিআইয়ের মিডিয়া লিটারেসি জরিপে গণমাধ্যমের খবর পড়েন না এমন ব্যক্তিদের ৪৩ দশমিক ৩ অংশ বলেছেন, সংবাদমাধ্যম পড়া বা দেখা সময় হয় না তাঁদের। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পরিচালিত জরিপ বাংলাদেশ জাতীয় জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের চাকরিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ কমেছে। এই একই সময় পুলিশসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে।

বিজ্ঞাপনের বাজার বড় হলেও সংবাদমাধ্যমগুলো পাচ্ছে অল্পই। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বড় হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবের আয় বেশি। সংবাদমাধ্যমের জন্য পরিবেশ জটিল, অস্পষ্ট এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সংবাদমাধ্যমগুলো যদি সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা মেনে সবার জন্য খবর প্রকাশ করে, তাহলে সংবাদমাধ্যমের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। সংকট মোকাবিলায় সরকার, মিডিয়া ও গবেষকদের মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকা দরকার।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, অদূর ভবিষ্যতে সরকার, মিডিয়া ও গবেষকদের একমঞ্চে আসার সম্ভাবনা কম। এখানে সবাই বিভক্ত। সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ আছে। প্রথম আলোর সরকারি বিজ্ঞাপন বাতিল করা হয়েছিল, এমনকি ৪৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রথম আলোয় বিজ্ঞাপন দিতে নিষেধ করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ আছে আরও। ২০১৫ সাল থেকে পত্রিকার ছাপা সংস্করণ কমছে।

কোভিডে এই সংখ্যা আরও কমে এবং আর কখনো ২০১৫ সালের আগের প্রচার সংখ্যায় ফেরত যাওয়া কঠিন হবে। কিন্তু এই সময়ে অনলাইনে পাঠক বেড়েছে। প্রথম আলো ছাপা ও অনলাইনকে সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশের জন্য ভালো পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই।

ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, নিয়ন্ত্রণমূলক আইন গণমাধ্যমের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরদিন এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনের পরদিন ছাপা কাগজ দুটোর পর্যালোচনা করে দেখলেই বিষয়টা বোঝা যায়। পাঠক মনে করছে, তারা সঠিক খবরটা পাচ্ছে না। শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নয়, মানহানির মামলাও বাধা তৈরি করছে। এমন আইন কোথাও পাওয়া যাবে না যেখানে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে লেখা হলে তৃতীয় একটি পক্ষ ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে এই আইন আছে, ম্যাজিস্ট্রেট সেই মামলা আমলে নেন এবং হাজিরা দিতে সম্পাদককে ৬৪ জেলায় ছুটে বেড়াতে হয়।

ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক বলেন, কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা গণমাধ্যমের জন্য প্রতিকূলতা তৈরি করে। শুধু বাংলাদেশই এই অবস্থা তা নয়, ট্রাম্প গেছেন। কিন্তু রাশিয়ায় পুতিন, ফিলিপাইনে দুতার্তে, ব্রাজিলে বলসোনারো ও চীনে সি চিন পিং আছেন। প্রচারণা ও মিথ্যা খবরের পেছনে প্রচুর বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে তাঁর মতে, শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যম কী খবর দিচ্ছে সেটাই মূল।

কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর সংগ্রহ করে যে সংস্থা প্রকাশ করছে, তার কাছ থেকে গণমাধ্যমকে সুরক্ষা দিতে হবে। সুরক্ষা দেওয়ার পথ খুঁজতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদুল ইসলাম বলেছেন, গণমাধ্যমের বিকাশের সঙ্গে গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতার সম্পর্ক আছে। কেন বিকল্প মিডিয়ার বিস্তার হচ্ছে, মানুষ আসলে কী চাইছে, সেটা খুঁজে দেখা দরকার।

গাজী টিভির এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা কমে আসার কথা বলেছেন। আর্টিকেল নাইন্টিনের আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেছেন, সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চললে তারা আস্থা হারাবে।

এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, শেষতক সাংবাদিকতাই টেকে। কিন্তু সে জন্য সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আবার মিডিয়ার অর্থনীতি ভালো না হলে সক্ষমতা বৃদ্ধির যে চেষ্টা চলছে, সেটা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

মিডিয়ার অর্থনীতিকে ভালো করতে কৌশলগত পরিবর্তনের কথা বলেছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রের এ-দেশীয় প্রধান গাউসুল আলম শাওন। তাঁর মতে, গণমাধ্যমের খোলনলচে বদলাতে হবে। সাবেকি ধাঁচের খবর আর ‘টিকটক’ প্রজন্মকে টানছে না। টেলিভিশন বা ডিজিটাল মিডিয়ায় বিনা মূল্যে খবর প্রচারের যে সংস্কৃতি, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। গাউসুল আরও বলেন, ডিজিটাল মিডিয়ায় জোর দিতে হবে বেশি, তাই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, দক্ষ জনশক্তি ও অবকাঠামোয় ব্যয় বাড়াতে হবে।

মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তাপ্রধান রেজওয়ানুল হক বলেন, কেব্‌ল অপারেটরদের সঙ্গে বহুবার তাঁরা বসেছেন। তাঁরাও আর বিনা মূল্যে খবর প্রচারিত হোক, তা চান না। কিন্তু কেব্‌ল অপারেটররা উল্টো টিভি চ্যানেলগুলোর থেকে টাকা দাবি করে।

ওয়েবিনারে আরও বক্তব্য দেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউটের আনা ম্যারিস, ইউল্যাব ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জুড উইলিয়াম, এশিয়া ফাউন্ডেশনের এ-দেশীয় প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ এডিটর সাখাওয়াৎ লিটন প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মিরাজ আহমেদ চৌধুরী।