মৃতের পুথি আবার জীবিত

মারুফ ঢালী
ছবি : সংগৃহীত

২০১৯ সাল। গ্রীষ্মের শেষ দিকের কোনো এক রাত। ঘড়িতে বাজে প্রায় দুটো। মধ্যপ্রাচ্যের রুক্ষ এক মরুশহরের নির্জন বিমানবন্দর। বর্ডার কন্ট্রোল পুলিশের ওয়েটিংরুম। আমার গন্ত্যব্য ছিল জর্ডান উপত্যকার মৃত সাগরের পাড়ের এক প্রাচীন শহর, নাম—কুমরান। নেদারল্যান্ডস থেকে পিএইচডি গবেষণার একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি, সঙ্গে আমার দুজন ডাচ সহকর্মী। যেহেতু জায়গাটা অনেকগুলো চলমান যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে এবং ঐতিহাসিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাই আমাদের আগে থেকেই বেশ কিছু অনুমতিপত্র নিতে হলো। কিন্তু বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেশন এবং বর্ডার কন্ট্রোল অফিসার বাদ সেধে বসলেন। সচরাচর কোনো বাংলাদেশি এ পথে আসে না। তাই কিছু অতিরিক্ত জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন, আমার সহকর্মীদের যেতে দিলেও হয়তোবা শেষ পর্যন্ত আমাকে যেতে দেওয়া হবে না। একটু হতচকিত আর নার্ভাস লাগছিল। মন খারাপ হয়ে গেল, এত দূর এসে বাকিটা যাওয়া হবে না ভেবে। ওয়েটিংরুমের চেয়ারে বসতে যাচ্ছি, দেখি আমার সুপারভাইজার-প্রফেসর আর অন্য এক পিএইচডির সহকর্মী পাশে এসে বসলেন। তাঁরা দুজনই আমার সঙ্গে একই বিমানে এসেছেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন পুলিশের শত অনুরোধেও তাঁরা আমাকে ছাড়া বিমানবন্দর থেকে বের হতে অসম্মতি জানালেন। মনে সাহস ফিরে এল। জাঁদরেল প্রফেসর আমার সামনেই অফিসারকে বললেন, ‘যদি যাই তবে সবাই একসঙ্গেই যাব। আমরা গবেষণার কাজে একটা দল হিসেবে এসেছি। আমার দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যদি না যেতে পারে তাহলে আমারও ভেতরে যাবার প্রয়োজন নেই।’ এতে কাজ হলো। কিছুক্ষণ পরেই আমি কুমরান শহরে যাবার অনুমতি পেলাম, সঙ্গে গবেষণার ছাড়পত্রও।

ছোট্ট একটা ঘটনা, কিন্তু মনে দাগ কেটে রাখল। দলগত কাজ কী, কীভাবে দায়িত্ব নিতে হয়, তা আরও একবার নতুন করে শিখলাম। এমন ছোট-বড় অনেক ঘটনা, অভিজ্ঞতা, সাফল্য-ব্যর্থতা মিলেই আমার পিএইচডির মূল গবেষণার জন্য পথচলা চলল কয়েক বছর ধরে।

আমার গবেষণার বিষয় হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—এআই) ব্যবহার করে ‘মৃতের পুথি’ বা ‘ডেড সি স্ক্রল’ নামের আড়াই হাজার বছরের পুরোনো হাতে লেখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপির বিশ্লেষণ করা। ‘ডেড সি স্ক্রল’ ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্বের গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পাণ্ডুলিপি। এতে ছোট-বড় হাজারখানেক স্ক্রল আছে। স্ক্রল বলতে মূলত রোল করা বা গোটানো কাগজ বোঝায়, যা বেশির ভাগ সময় চামড়া বা প্যাপিরাস দিয়ে তৈরি হয়।

এ বছরের শুরুর দিকে আমাদের গবেষণার একটি কাজ বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের পর রাতারাতি গোটা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেয়। এটি ছিল মূলত ‘ডেড সি স্ক্রল’ সংগ্রহের একটি বিশেষ পণ্ডুলিপি নিয়ে। ‘অ্যাইজায়াহ স্ক্রল’ নামে পরিচিত এই নথি প্রায় ২৪ ফুট লম্বা, চামড়া দিয়ে তৈরি এবং হাতে লেখা ৫৪টি কলামে বিস্তৃত। বহু বছর ধরে গবেষকদের ধারণা ছিল, এই পুরো স্ক্রলটি একজনের লেখা। কিন্তু ধারণাটি ছিল অনুমাননির্ভর। কারণ, চোখে দেখে এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে কোনো মানুষের পক্ষে নিশ্চিত ও নিরপেক্ষভাবে ব্যাপারটি বলা অসম্ভব। এই জায়গাতেই আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করি। অনেক পুরোনো চামড়া থেকে আদি ও আসল লেখাগুলোকে বের করে আনা, প্রতিটি অক্ষরের বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে লেখকের কলম ধরা বা লেখার গতিপ্রকৃতি নির্ণয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, গণিত-পরিসংখ্যান ও অত্যাধুনিক প্যাটার্ন রিকগনিশন ব্যবহার করেছি আমরা। শেষে সব ধরনের পরীক্ষার ভিত্তিতে আমাদের গবেষণাপত্রটি এই সিদ্ধান্ত দেয় যে স্ক্রলটি একজন না, বরং দুজন লেখক লিখেছেন।

এই আবিষ্কারটির কয়েকটি যুগান্তকারী দিক আছে। কোনো ইতিহাসবিদ, ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিত বা বিজ্ঞান গবেষক—কারোরই একক কাজের ওপর ভিত্তি না করে নিরপেক্ষভাবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা ইতিহাস পুনঃপাঠের সুযোগ তৈরি করেছি। আমাদের আবিষ্কারটি তাই বিশ্বের বহু গবেষক, কৌতূহলী মানুষ আর গণমাধ্যমের প্রশংসা পেয়েছে।

এত কিছু ছাড়াও একটা বিশেষ কারণে এই গবেষণাটি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজটি এমন একটা সময়ে প্রকাশ পায়, যখন পুরো পৃথিবী কোভিডের কারণে বিপর্যস্ত। আমি যে নেদারল্যান্ডসে থাকি, সেখান থেকে শুরু করে আমার নিজের বাংলাদেশ এবং গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে যে যেখানে আছেন, সবার কাছ থেকেই একের পর এক মন খারাপ করা সংবাদ পাচ্ছিলাম। উপরন্তু আমার বসবাসের শহরে তখন চলছিল লকডাউন! আমার বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার কাজের জায়গা—সব প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। চারদিকে কেমন যেন দমবন্ধ একটা ভাব! গবেষণাপত্রের পুরো কাজটি এই কঠিন সময়ের ভেতরে করা, বিরতি দেওয়ার সুযোগ যে নেই। ‘শো মাস্ট গো অন’! তাই এই সাফল্যটুকু আমার কাছে বিশেষ কিছু।

মারুফ ঢালী

গবেষক

জন্ম

১৯৮৭, ঢাকা

পড়াশোনা

কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক (২০০৩) ও উচ্চমাধ্যমিক (২০০৫), ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক (২০১০), যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ভিশন ও রোবটিকস নিয়ে স্নাতকোত্তর (২০১৫); এখন নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক

অর্জন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ‘ডেড সি স্ক্রল’ নামের পুরোনো পাণ্ডুলিপির বিশ্লেষণ

এখানে একটা ব্যাপার না বললেই নয়, কাজটি হয়তো কখনোই আলোর মুখ দেখত না যদি আমার পরিবার, সহকর্মী ও সুপারভাইজারদের অবিরাম সহায়তা না পেতাম। লকডাউনের জন্য যখন সব বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তখন বিশেষ পাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো, যাতে আমি বিভাগের গবেষণাগারে গিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারি। এমন বহুদিন হয়েছে, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমি একা। কখনো কোনো সহকর্মী, কখনোবা নিরাপত্তারক্ষী কখনো আবার আমার প্রফেসর নিজেই এসে দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলে যেতেন। একজন আরেকজনকে সাহায্য করা, হাল না ছাড়তে সাহস দেওয়া, কিংবা শুধুই গল্প করে কিছু সময় কাটানো—এই ছোট ছোট ব্যাপার কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সাফল্যের সামনে বা গবেষণাপত্রের পাতায় হয়তো এসব লেখা থাকে না, কিন্তু প্রতিটি কাজের পেছনেই থাকে একগাদা মানুষের অবদান।

এবার একটু পেছনে ফিরে যাই, কীভাবে আমি নেদারল্যান্ডসের এই ‘ডেড সি স্ক্রল’–এর গবেষণার কাজে এলাম?

আমার পড়াশোনার শুরু বাংলাদেশেই—কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে, তারপর ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইইউটি)। স্নাতক শেষে দুই বছর আইইউ টিতেই শিক্ষাকতা করি তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগে। এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃত্তি নিয়ে কম্পিউটার ভিশন ও রোবোটিকসের ওপর স্নাতকোত্তর করি যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মাস্টার্স শেষে পিএইচডি গবেষকের পদ খুঁজছিলাম বিভিন্ন গবেষণা গ্রুপে। এর মধ্যে নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডেড সি স্ক্রল’ টিমের কাজগুলো দারুণ আকর্ষণীয় মনে হলো। অনেকগুলো কারণের ভেতর একটি বড় কারণ ছিল, এটি বহু জাতি ও সংস্কৃতি এবং বহু শাস্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল, যেখানে একই সঙ্গে ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, কৃত্রিম বুদ্ধমত্তা, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের গবেষকেরা কাজ করেন। ফলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই গবেষণা দলে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করে ফেলি। বেশ কিছু মৌখিক পরীক্ষা আর চড়াই-উতরাই পার হয়ে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য থেকে চলে এলাম নেদারল্যান্ডসে। যোগ দিলাম গ্রোনিঙ্গেনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিভাগে, প্রফেসর ল্যাম্বার্ট শমেকার ও প্রফেসর ম্লাদেন পপোভিচের সেই বিখ্যাত গবেষণা দলে।

কেমন ছিল গত চার-পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা, পিএইচডির এই পথচলা? সত্যি বলতে, সাফল্য-ব্যর্থতার চেয়েও সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো এই পথচলাটুকুই। অনেক অনেক অভিজ্ঞতা, নতুন করে অনেক কিছু শেখা। ভিন্ন দেশের, ভিন্ন মতের, ভিন্ন দক্ষতার মানুষের চিন্তা ও মতকে সমানভাবে প্রাধান্য দেওয়া। বহু সফল মানুষকে দেখেছি কীভাবে অহংবোধকে পাশে ফেলে প্রত্যেক মানুষের প্রতিটি আইডিয়া, প্রতিটি সমস্যাকে সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

ছোট একটি ঘটনা বলে শেষ করি। আমি তখন পিএইচডির একেবারে প্রথম দিকে। ‘ডেড সি স্ক্রল’-এর ছবিগুলো থেকে সব বর্ণমালা পরিষ্কারভাবে বের করে আনার জন্য একটি অটোমেটিক সিস্টেম ডেভেলপ করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু অনেক ক্ষতিগ্রস্ত এই পুরোনো কাগজগুলোতে কিছুই যেন কাজ করছিল না। আমি একেক দিন অফিসে আসি, নতুন একটা করে অ্যালগরিদম নিয়ে কাজ করি এবং দিন শেষে মন খারাপ করে বাসায় ফিরি; কিছুই যেন হওয়ার নেই। এভাবে অর্ধেক বছর চলে গেল, কিন্তু ফলাফলের দেখা নেই। এ অবস্থায় একদিন কথা হলো আমাদের ফ্যাকাল্টির এক সিনিয়র প্রফেসরের সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কাজ কেমন চলছে। শেষে আমার অবস্থা শুনে তাঁর নিজের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। তাঁর পিএইচডির সময় ছোট একটা কাজ নিয়ে তিনি আট মাসেরও বেশি সময় ধরে আটকে ছিলেন। সে সময় তাঁর মনে হয়েছিল, গবেষণার কাজ বোধ হয় হবেই না! একপর্যায়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি, চেষ্টা চালিয়েছেন এবং দিন শেষে ঠিকই সফলভাবে নিজের কাজটি শেষ করেছেন। এই প্রফেসরের নাম বেন ফেরিঙ্গা, ২০১৬ সালে রসায়নে নোবেলজয়ী।

বেন ফেরিঙ্গার ঘটনাটি আমাকে অন্য রকম এক প্রেরণা দিল। ভাবলাম, আসলেই তো যেকোনো কাজেই কঠিন সময় আসতে পারে, আসতে পারে বাধা; আটকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু থেমে যাওয়া যাবে না, চেষ্টা করে যেতে হবে ও লেগে থাকতে হবে। আমার নিজের ক্ষেত্রে, প্রায় দুই বছর চেষ্টার পরে আমি একটি আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক ডেভেলপ করতে সক্ষম হই, যা নিখুঁতভাবে ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি থেকে পুরোনো বর্ণমালা উদ্ধার করতে সক্ষম।

এখন আমার, আমাদের চাওয়া হলো, এই কাজগুলো যেন ভবিষ্যতে নতুন অনেক গবেষণার দরজা খুলে দেয়। আর শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও গবেষণার কাজে উৎসাহিত করে।

  • মারুফ ঢালী: নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই বিভাগের প্রভাষক