মেঘলা দিনে ঈদ আনুক খুশির রোদ্দুর

ছোটরা বেশি উত্তেজিত। কাঁঠালপাতা জোগাড় করো, ছাগলকে খাওয়াও, দড়ি ধরে সেটাকে টেনে একটু ছায়ায় বেঁধে রাখো। বড়রা হাটে চলেছেন, এবারের পশুর দর কেমন, এই হাটে কম, নাকি ওই হাটে। রাস্তায় একটা বিশাল গরুকে সামলাতে ব্যস্ত চারজন; তবু তাকে বশে আনা যাচ্ছে না। যাঁরা গরু বা ছাগল কিনে বাড়ি ফিরছেন, তাঁদের যদি আপনি জিগ্যেস করেন, ‘শরীর কেমন’, উত্তর আসবে, ‘এক লাখ দশ।’ জনপদের পথে পথে ঘুরছেন সেই চাকাওয়ালা, যার মুখে হাঁক—‘ছুরি-বঁটি ধার করাবেন!’ বাড়ির নারীরা ব্যস্ত পেঁয়াজ কাটা আর মসলা পেষা নিয়ে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে কাগজ বিছিয়ে সারা রাত অপেক্ষা, সকালে কাউন্টার খুললে বাড়িফেরার টিকিট পাওয়া যাবে। রাত কাটে, ভোর হয়, ঠিক আপনি কাউন্টারে পৌঁছানোর সময় এল সেই নিষ্ঠুরতম খবর, ‘টিকিট শেষ’। তবু বাড়ি ফিরতেই হবে। ট্রেনের ছাদে, লঞ্চের ছাদে চড়ে। বাসে চলেছেন, তো টাঙ্গাইলে ২৫ কিলোমিটার যানজটে থাকুন বসে। কী কষ্ট! কী কষ্ট! এরপরও মাঝরাতে ছেলে ঘুমিয়ে পড়া হাটঘাট পেরিয়ে বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়ায়, ‘মা মা, আমি আইয়া পড়ছি’, মসলার ঘ্রাণমাখা আঁচল সামলাতে সামলাতে প্রৌঢ়া জননী যখন দরজা খোলেন, পৃথিবীর সব দুঃখের অবসান ঘটে যায় ওই মুহূর্তটিতে। লজ্জা ভেঙে বধূ এসে দাঁড়ায় পাশে, ‘এত রাত হইল?’ আহা, আমার বাংলাদেশ। আহা, আমার বাংলাদেশের ঈদ। ঈদ মানে এখানে বাড়ি ফেরা।

নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতায় মায়ের কাছে ছেলের ফেরার কথা মনে পড়ে:

‘আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে

ডাকলুম,— “মা’৷...

মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ ক্যাচ্ শব্দ করে খুলে গেলো...

কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;

সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে

একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম৷’’

কিংবা মনে পড়ে, আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতাটা:

‘...বৈঠকখানা থেকে আব্বা

একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,

ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান …।

বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।’

পবিত্র ঈদুল ফিতরে টিভিতে নজরুলের গান ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ।’ পবিত্র ঈদুল আজহার আগে টেলিভিশনে পবিত্র হজের সরাসরি সম্প্রচার দেখা। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।’ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির।’

এই সব পরিচিত দৃশ্য আবারও রচিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে। কাল ঈদ। তবে এবারের ঈদে আছে আরও কিছু সমসাময়িক প্রসঙ্গ। কোটি মানুষ এখনো বন্যার ধকল সামলে উঠতে পারেননি, তাঁরা বলছেন, ‘এবার ঈদে আনন্দ নেই।’ প্রথম আলোর শিরোনাম, ‘হাওরপারে, সোমেশ্বরীর তীরে নেই ঈদ আনন্দ’। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে পৃথিবীজুড়ে তেল-গ্যাসের সংকট, শতভাগ বিদ্যুতের দেশে শুরু হয়েছে বিপর্যয়কর লোডশেডিং। ডলারের আক্রা। প্রধানমন্ত্রী বলছেন কৃচ্ছ্র করতে। জিনিসপাতির দাম বেশি। বাঁধা আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তেল ছাড়া রান্না, মাংস ছাড়া মাস কাবার করা শিখে নিতে হচ্ছে। বন্যার্ত অসহায় মানুষ ভাঙা ঘর মেরামত করতে পোষা গরু নিয়ে গেছেন কাদাভরা হাটে, ক্রেতা কই? ঢাকার মসলার বাজারেও দাম পড়তির দিকে। করোনা সংক্রমণের চতুর্থ ঢেউ বইছে দেশজুড়ে। করোনা-পজিটিভ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। লক্ষণাক্রান্তদের মধ্যে ১৬ ভাগের মতো পজিটিভ। এবারের ঈদযাত্রা, হাটযাত্রা, ঈদের জামাত মাস্ক পরে করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

সুখবরও আছে। রপ্তানি আয়ের রেকর্ড করেছে দেশ। ঈদের আগে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বেশি বেশি করে। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে ঈদযাত্রা অনেকটাই সহজ আর স্বস্তির। রোমাঞ্চকরও হয়তো।

সামাজিক মাধ্যমে গরু-ছাগলের ছবি আসতে শুরু করেছে। স্বজনেরা যাঁরা হজ করতে গেছেন, ফেসবুকে তাঁদের ছবিও দেখছি। ঢাকা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচা, ঘরে বসে কোরবানি করা ও মাংস পাওয়ার সেবা—নতুন দিনের নতুন ছবিও দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি নাগরিক উদ্যোগ। বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ নিয়ে ছুটছেন নাগরিকেরা, বিশেষ করে তরুণেরা। আবার কোরবানির মাংস বন্যাকবলিত এলাকার মানুষদের মধ্যে পৌঁছানোর উদ্যোগও দেখতে পাচ্ছি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর অ্যাপগুলো এই সময়ে ভীষণ কাজে লাগে। দূরবর্তী সুবিধাবঞ্চিত স্বজনকে ঈদ উপহার হিসেবে মোবাইলে টাকা পাঠানোই হতে পারে ছোট্ট কিন্তু চমৎকার একটা উদ্যোগ। যেমন প্রবাসীরা যদি বৈধ চ্যানেলে দেশে স্বজনের কাছে যদি ১০০ ডলারও পাঠান, তাতে যেমন দেশের লাভ, তেমনি একটা পরিবারের মুখে ফুটে উঠতে পারে প্রসন্নতার আলো।

এই আলো-আঁধারি সময়ে, এই ঈদে আমরা তো প্রতিটা মুখে হাসিই দেখতে চাই। মেঘলা দিনে ঈদ আনুক খুশির রোদ্দুর।