মেয়ে শেখ রেহানার মুখে বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা

শেখ রেহানা
ফাইল ছবি

‘সব শিশুর চেয়ে তিনি ছিলেন একটু অন্য রকম। বাড়ির মুরব্বি, শিক্ষক, কৃষক, মাঝি—সবাই একবাক্যে স্বীকার করতেন, এই বাচ্চাটা অন্য সব বাচ্চা থেকে একটু অন্য রকম’—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কথাগুলো তাঁর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার।

বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উদযাপনে ঢাকার স্কলাসটিকা স্কুল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাবাকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ধরেন শেখ রেহানা। বুধবারের এই অনুষ্ঠানে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার শিরোনামই ছিল ‘আমার বাবার ছেলেবেলা’।

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। কালে তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, তাঁর হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ, তিনি হন জাতির পিতা। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে এক বছর ধরে উদযাপিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি।

শেখ রেহানা বলেন, ‘আমার দাদা-দাদি, ফুফু, মায়ের মুখে শোনা এবং আব্বার নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে জানতে পারি এসব গল্প…এই শিশুর আগমনে আজানের ধ্বনি, মধুমতী নদীর ঢেউ, পাখিদের কলতানে পুরো গ্রাম যেন আনন্দে মেতে ওঠে। সারা গ্রামে মিষ্টি ও খুরমা বিলানো, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে কাপড় বিলানো, মিলাদ পড়ানো নানা—আয়োজনে উৎসবে পরিণত হলো গ্রামটি।’

একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিব তখন ছিলেন সবার আদরের খোকা। এ কোল থেকে ও কোলে চড়ে আনন্দেই শিশুকাল পার করছিলেন। শেখ রেহানা বলেন, ‘সবার চোখের মণি, বড় দুই বোন তো কোল থেকে নামাতেই চাইতেন না। আরও একটু বড় হওয়ার পর আস্তে আস্তে আরবি, বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, অঙ্কসহ লেখাপড়াটা শুরু করে দিলেন।’

বাবা লুৎফর রহমানের কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর। শেখ রেহানা বলেন, ‘আমার আব্বার জীবনে শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন সবচেয়ে শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর শিক্ষাগুরু। দাদা প্রচুর বই কিনে আনতেন। ইতিহাস, ভূগোল, ইংরেজি, বাংলা, ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, বড় বড় মনীষীদের জীবনী, ব্রিটিশদের অত্যাচারের কথা। তিনি নিজেই ছেলেকে পড়ে শোনাতেন। টুঙ্গিপাড়া থেকে গোপালগঞ্জে এনে মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে। বাবার সঙ্গে গোপালগঞ্জ শহরেই থাকতেন।’

তিনি বলেন, ‘ছোট্ট মুজিব সবকিছু জানতে চাইতেন। বাবাকে প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করতেন। তাঁর বাবাও ছেলের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। আবার দাদা আর আমার আব্বা মুজিব ছিলেন ঠিক বন্ধুর মতন। যেমন শ্রদ্ধা আর সমীহ করে চলতেন, তেমনি সবকিছু তাঁর সঙ্গেই নিঃসংকোচে আলোচনা করতেন। কোনো দিনও তাঁর খোকাকে কোনো কাজে বাধা দিতেন না।’

ছেলেবেলায়ই বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানুষের জন্য অন্তঃপ্রাণ। শেখ রেহানার ভাষায়, ‘ছোটবেলা থেকে তাঁর মনটা অনেক বড়, অনেক পরোপকারী। কারও দুঃখ-কষ্ট দেখলে এগিয়ে যাওয়া, নিজের জামা খুলে অন্যের গায়ে তুলে দেওয়া, খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া দেখে মুগ্ধ নয়নে সবাই তাকাত, আর দোয়া করত।’

একটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একবার এলাকায় খুব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো, ফসলের অনেক ক্ষতি হলো। ঘরে ঘরে খাবারের জন্য হাহাকার। ছোট মুজিবের মনে মানুষের জন্য অনেক কষ্ট। দাদা-দাদিকে বলে আমাদের গোলাঘর থেকে ধান-চাল বিলানো শুরু করলেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে যাদের নেই, তাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। একবার আমার দাদা কলকাতা থেকে সুন্দর একটা আলোয়ান (চাদর) কিনে আনলেন ছেলের জন্য। তিনি সেটা পরে বাইরে বের হলেন ঘুরতে। ফেরার পথে দেখেন জীর্ণশীর্ণ বয়স্ক একজন মানুষ গাছের নিচে বসে প্রচণ্ড শীতে কাঁপছেন। আব্বা সেটা দেখে নিজের চাদরটা তাঁর গায়ে পরিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে এলেন শীতে কাঁপতে কাঁপতে।’

চোখে সমস্যা দেখা দেওয়ায় শৈশবেই মুজিবের চোখে অপারেশন করা হয়। এরপর চশমা পরা নিয়ে কতটা বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন, সে গল্পও উঠে আসে তাঁর মেয়ের বর্ণনায়। তিনি বলেন, ‘সুদর্শন বালক, চোখে চশমা-ক্লাসের সবার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। বয়সে বড় দেখে ক্লাসে সবাই মিয়াভাই ও ভাইজান বলে ডাকে। এই কিশোর বালকের মধ্যে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন। একবার কেউ ওনার সান্নিধ্যে এলে সে ভক্ত হয়ে যেত। ঠিক চুম্বকের মতন আকর্ষণ করত।’

সেই ছেলেবেলায়ই বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তার কথা তুলে ধরে মেয়ে বলেন, ‘কিশোর মুজিবের নাম তখন গোপালগঞ্জে অনেক জনপ্রিয়। যত সুনাম হতে লাগল, ততই কিছু ছাত্র-মানুষের হিংসার পাত্র হয়ে উঠতে লাগলেন তিনি। আজেবাজে নালিশ করে দাদার কান ভারী করার চেষ্টা করতে লাগল। শেখ লুৎফর রহমান সাহেবের সন্তানের ওপর অগাধ বিশ্বাস। খোকা কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। তবে দু-একটা দুষ্টুমি তো জানতই। বাবা জানতে চাইলে উনি মাথা নিচু করে দোষ স্বীকার করতেন।’
খেলাধুলা, গান-বাজনার সঙ্গেও যে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ ছিল, তা-ও উঠে আসে মেয়ে শেখ রেহানার কথায়, ‘খেলাধুলার পাশাপাশি গান-নাচও চলত। ব্রতচারী একটা সংগঠন ছিল। সেখানে নাচ-গান হতো, ঢোল বাজিয়ে গান-নাচ করে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনা করা হতো। এই দলেও যোগ দিলেন মুজিব। তাতে তরুণদের শরীরচর্চাও হতো, গানের ভাষায় সবার কাছে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথাও পৌঁছে যেত। একবার ছাত্র ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়েছিল, সেখানে বাবার বিপক্ষে ছাত্রদের দলনেতা হয়েছিলেন শেখ মুজিব। শেষ পর্যন্ত বাবা শেখ লুৎফর রহমানের দল জিতে যায়।’

কৈশোরেই রাজনীতির কঠিন মাঠে বঙ্গবন্ধু পা রাখার কথা তুলে ধরে শেখ রেহানা বলেন, ‘১৯৩৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গিয়েছিলেন গোপালগঞ্জে। সেখানে অনুষ্ঠান শেষে ফিরে যাওয়ার সময় সোহরাওয়ার্দী মুজিবের নাম-ঠিকানা নেন এবং কলকাতায় তাঁর নিজের ঠিকানা দেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “মুজিব, তুমি এখানে একটা সংগঠন করো। মুসলমান ছেলেদের নিয়ে। মুসলিম পরিষদ নাম দিয়ে।” এই কথা শুনে মুজিবের খুশি তো আর ধরে না। যেন মনের কথাটাই উনি বলে গেলেন। সেটাই শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। তাও কিনা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছ থেকে!’

দুরন্তপনার ওই বয়স না পেরোতেই সংসারজীবনে পা রাখতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেছা রেণুর সঙ্গে। নিজের মা-বাবার সেই গল্প আজকের শিশুদের শুনিয়ে শেখ রেহানা বলেন, ‘মুজিবের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন রেণু। জীবনে চলার পথে এমন কিছু ছিল না যে দুই বন্ধু মিলে আলোচনা না করতেন এবং একই সঙ্গে পৃথিবী থেকে দুজন বিদায় নিয়েছেন।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বলতে গিয়ে রেহানা শিশুদের ‍তুলনা দিলেন কার্টুন ছবি থেকে। তিনি বলেন, ‘সোনামণিরা, তোমরা নিশ্চয় কার্টুন দেখতে পছন্দ করো। আমি কিন্তু দারুণ ভালোবাসি। লায়ন কিং কার্টুনে নিজের কাছের লোক যেভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করল, মুজিবের সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠ কিছু দুষ্ট লোক হিংসা, ষড়যন্ত্র করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল।’

স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা টানা এক যুগ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পরবাসে নিজেদের সংগ্রামের কথা তুলে ধরে শেখ রেহানা বলেন, ‘আমরা দুই বোন একে অপরের পাশে আছি। দুজন দুজনকে সাহায্য করি। খুব ভালোবাসি।’