মোট প্রজনন হার নিয়ে বিভ্রান্তি

জনসংখ্যা কার্যক্রম, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষেত্রে টিএফআর বা প্রজনন হারের গুরুত্ব রয়েছে।

ফাইল ছবি

দেশে মোট প্রজনন হার (টিএফআর) নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। অথচ দেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি বোঝার একটা অন্যতম নির্দেশক টিএফআর। টিএফআর বাড়লে-কমলে জনসংখ্যাও বাড়বে-কমবে। জনসংখ্যা কার্যক্রম, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষেত্রে টিএফআরের গুরুত্ব রয়েছে।

একজন নারী তাঁর প্রজনন বয়সে গড়ে যতটি সন্তানের জন্ম দেন, সেটাই টিএফআর। অর্থাৎ দেশের দম্পতিরা গড়ে কতটি সন্তান নিচ্ছেন, তার ধারণা পাওয়া যায় টিএফআর থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্‌লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টিএফআর ভিন্ন ভিন্ন দেখানোর সমস্যা রয়েছে। কোনো বিষয়ে পরিকল্পনার মূল জায়গা হচ্ছে সঠিক তথ্য। খুব দ্রুত জনশুমারি করে টিএফআরের বিভ্রান্তি দূর করা প্রয়োজন।

গবেষকেরা সাধারণত জনসংখ্যা বিষয়ে বিডিএইচএসের প্রতিবেদনের তথ্য ব্যবহার করে থাকেন। পরিসংখ্যান আইন ২০১৩-এ বিবিএসকে পরিসংখ্যানের বিষয়ে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

টিএফআর ভিন্ন ভিন্ন দেখানোর সমস্যা রয়েছে। কোনো বিষয়ে পরিকল্পনার মূল জায়গা হচ্ছে সঠিক তথ্য। খুব দ্রুত জনশুমারি করে টিএফআরের বিভ্রান্তি দূর করা প্রয়োজন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্‌লাল হোসেন, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দুই সংস্থার দুই তথ্য

বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’ অনুসারে টিএফআর ২ দশমিক শূন্য ৪। ২০১৯ সালেও সংস্থাটি একই টিএফআরে তথ্য জানিয়েছিল। এই হিসাবে ২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশের দম্পতিরা গড়ে দুটির সামান্য বেশি সন্তান নিয়েছেন।

তবে একই সংস্থা ইউনিসেফের সঙ্গে এক যৌথ প্রতিবেদনে (মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯) জানিয়েছে, টিএফআর ২ দশমিক ৩। এই হার মিলে যায় বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদনের সঙ্গে। প্রতি তিন বছর পরপর এই বিডিএইচএস জরিপটি করে সরকারের আরেকটি সংস্থা জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)। বিডিএইচএসের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১১ সাল থেকে টিএফআর ২ দশমিক ৩-এ স্থির হয়ে আছে।

ভিন্ন গবেষণা পদ্ধতি গ্রহণের কারণে তথ্যে ভিন্নতা হয়েছে বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিবিএস ও বিডিএইচএস দুটি জরিপ ভিন্ন প্রক্রিয়া ও ভিন্ন উৎস থেকে হয়েছে বলে টিএফআরে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। ১৫ জুন জনশুমারি শুরু হবে। এই শুমারির পর যথাযথ তথ্য উঠে আসবে। সর্বশেষ ২০১১ সালে জনশুমারি হয়েছিল।

শুমারি না হওয়ায় ভিন্ন জরিপের কারণে দেশের জনসংখ্যার প্রবণতা বুঝে পরিকল্পনা করতে সমস্যা হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এতে কোনো সমস্যা হবে না। তা ছাড়া জনসংখ্যা কমে আসছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। আগে দম্পতিরা ছয়টির বেশি সন্তান নিতেন। এখন এ হার দুটিতে নেমে এসেছে।

জনসংখ্যার তথ্যে গরমিল

বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ। এই প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও টিএফআর নিয়ে যেসব তথ্য দিচ্ছে, তাতেও গরমিল দেখা যাচ্ছে।

সংস্থাটির ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২২’ প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের টিএফআর ১ দশমিক ৯ এবং ২০২২ সালে মোট প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৯ লাখ। সংস্থার আগের বছরগুলোর প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের জনসংখ্যা ২০২১ সালে ১৬ কোটি ৬৩ লাখ, ২০২০ সালে ১৬ কোটি ৪৭ লাখ, ২০১৯ সালে ১৬ কোটি ৮১ লাখ, ২০১৮ সালে ১৬ কোটি ৬৪ লাখ ছিল।

সরকার এখন বলছে, দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) এই তথ্য ব্যবহার করছে।

নিপোর্টের ঊর্ধ্বতন গবেষণা সহযোগী এ কে এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আগে সরকার শুধু বিডিএইচএসের তথ্য নিত। এখন বিবিএসের তথ্য নিচ্ছে। দুটি সংস্থার টিএফআর তথ্যে ভিন্নতা রয়েছে। ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে টিএফআর ও জনসংখ্যার প্রাক্কলিত হিসাব দিয়েছে। এ কারণে জনসংখ্যা কম দেখা যাচ্ছে।

‘সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া কঠিন’

সবশেষ ২০১৭-১৮ সালের বিডিএইচএস প্রতিবেদনে টিএফআর, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হারে (সিপিআর) কোনো অগ্রগতি নেই। চার দশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যে সাফল্য দেখিয়েছিল বাংলাদেশ, ২০১১ সালের পর থেকে তা অনেকটাই স্থবির। ১৯৭৫ সালে টিএফআর ও সিপিআর ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫ ও ৮ শতাংশ। টিএফআর কমানো ও সিপিআর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে জনসংখ্যা কমে আসে।

বিডিএইচএসের সবশেষ জরিপ অনুসারে, সিপিআর ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০ অনুসারে সিপিআর প্রায় ৬৪ শতাংশ।

করোনাকালে বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের জন্মহার পর্যালোচনা করেছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত সংস্থাটির ‘হাউ উইল দ্য কোভিড-১৯ অ্যাফেক্ট বার্থস’ প্রতিবেদন বলছে, করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসামগ্রী মজুত থাকলেও তা সরবরাহ কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা ছিল। বাংলাদেশ, বেনিন, ভুটান ও কসোভোতে মহামারির শুরুতে সাময়িকভাবে শিশুজন্ম বেড়ে গিয়েছিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের জুন, ২০২১ সালের এপ্রিল ও আগস্টের দিকে কোভিড-১৯-এর উচ্চ হার ছিল। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহ সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ কমেছে ৪১ শতাংশের বেশি।

করোনাকালে টিএফআরের বিষয়ে তথ্য পেতে জরিপের ওপর জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, টিএফআর ও সিপিআর ব্যবহারে কোভিড-১৯-এর কী প্রভাব পড়েছে, সে সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রকৃত ও হালনাগাদ উপাত্তের ভিত্তিতে টিএফআর হতে হবে।

অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম আরও বলেন, কোভিডের শুরুতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ওই সময় বাল্যবিবাহও বেড়েছিল বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। বাল্যবিবাহ হয়ে থাকলে কম বয়সে গর্ভধারণের ঘটনাও ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। কোভিডের সময়ের অবস্থা জরিপের মাধ্যমে উঠে না এলে টিএফআর হার ও জনসংখ্যা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না। ফলে জনসংখ্যা, মাতৃস্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা করাও কঠিন হবে।