বৈশ্বিক পরিস্থিতি
মোটরসাইকেলে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার দেশে
দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে ২৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। মৃত্যুর এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ।
মোটরসাইকেল চালিয়ে শেরপুর জেলা শহর থেকে সদর উপজেলার হালগড়া চকবড়ইগাছিতে গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন বিজিবি সদস্য মো. ইউসুফ জামিল (২৬)। পথে আমতলী সেতুর ওপর পৌঁছালে তিনি মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণা বলছে, প্রতিবছর দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন ২৮ দশমিক ৪ জন। তাঁদের প্রায় ৪০ শতাংশেরই বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এই হার সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ। যদিও মাথাপিছু মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত গবেষণাটি করেছে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)। গত বছর শেষ হওয়া এই গবেষণায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, এমন ১৬টি দেশের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন ভিয়েতনামের মানুষ। সেখানে প্রতি ১ হাজার মানুষের বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে ৩৫৮টি। বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য মোটরসাইকেল আছে মাত্র ৭টি।
কিন্তু ভিয়েতনামে দুর্ঘটনার হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম, ৪ দশমিক ১ (প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে)। মৃত্যুহারে বাংলাদেশের পরেই রয়েছে কম্বোডিয়া। তবে দেশটিতে মৃত্যুহার বাংলাদেশের অর্ধেকের কম (১১ দশমিক ৯)। ভারতে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে প্রাণ হারান ৯ জন। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় এই বাহনের দুর্ঘটনা সবচেয়ে কম ভুটানে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে মারা যান ২ জন।
রাজনীতিবিদেরা এলাকায় গেলে তাঁদের পেছনে এক-দেড় শ মোটরসাইকেলের শোডাউন করা হয়। এটিও আইন অমান্য করাকে উৎসাহিত করে।ইলিয়াস কাঞ্চন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, নিসচা
বুয়েটের করা এই গবেষণার অন্যতম গবেষক ও এআরআইয়ের সহকারী অধ্যাপক আসিফ রায়হান বলেন, মোটরসাইকেল ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। অনেকেই দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেন না, মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করার প্রবণতাও বেশি। সড়কে কোন ধরনের যানবাহন কত সংখ্যায় চলবে, তার নিয়মনীতি নেই। এতে সড়কে বিশৃঙ্খলা হয়। এতে দুর্ঘটনা ঘটে।
৪৯ বছরে বেড়েছে ৪৮ গুণ
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী রিফাত আহমেদ সম্প্রতি একটি মোটরসাইকেল কিনেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রতিদিন মতিঝিলের অফিসে যাতায়াতে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ১০ মিনিটের রাস্তা যেতে লাগে আধা ঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট। তাই সময় বাঁচাতে ও চলাচলের স্বাধীনতার জন্য তিনি মোটরসাইকেল কিনেছেন।
রিফাতের মতো অনেকেই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে মোটরসাইকেল কিনছেন। অ্যাপের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনেও যুক্ত হচ্ছেন অনেক তরুণসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এতে করে মোটরসাইকেলের চাহিদা বাড়ছে।
দেশে যেকোনো মোটরযানের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৩৭ লাখ ১ হাজার ৭৮৬টি মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। তবে এমন নয় যে নিবন্ধিত সব মোটরসাইকেলই সচল আছে। একটা সময় পর তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সাধারণত মোটরসাইকেলের গড় আয়ুষ্কাল ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরা হয়।
বুয়েটের গবেষণা বলছে, দেশ স্বাধীনের পর ৪৯ বছরে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ গুণ।
বুয়েট এআরআইয়ের পরিচালক ও গবেষণাটির নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মনে করেন, উন্নত গণপরিবহন ছাড়া মোটরসাইকেলের ব্যবহার কমানো কঠিন। তবে মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
প্রতি তিনজনের একজন দুর্ঘটনার শিকার
বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে মোট ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। আর ২০২১ সালে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ৩৯ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এর আগের বছরের চেয়ে ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ ও মৃত্যু ৫১ শতাংশ বেড়েছে।
বুয়েটের গবেষণা বলছে, মোটরসাইকেলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩০ শতাংশ) দুর্ঘটনা ঘটে মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে। এই বাহনের দুর্ঘটনায় যতজন মারা যান, তাঁদের অর্ধেকই মারা যান মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে। এই গবেষণার অংশ হিসেবে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাঁদের এক-তৃতীয়াংশই জানিয়েছেন, গত এক বছরে তাঁরা অন্তত একবার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে টাকা থাকলেই মোটরসাইকেল কিনে রাস্তায় নামানো যায়। যাঁরা সাইকেল চালাতে পারেন তাঁরা মনে করেন, অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। তাঁরা জানেন না, দুজনের বেশি মোটরসাইকেলে উঠলে কী ক্ষতি। ট্রাফিক আইন ও অন্যান্য নিয়মনীতি সম্পর্কেও ধারণা নেই তাঁদের। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহন মহাসড়কেও চালানো হয়, অথচ মহাসড়কের জন্য এই বাহন প্রস্তুতই করা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা এলাকায় গেলে তাঁদের পেছনে এক-দেড় শ মোটরসাইকেলের শোডাউন করা হয়, এটিও আইন অমান্য করাকে উৎসাহিত করে।’
‘বেশি সিসির মোটরসাইকেলে ঝুঁকি বেশি’
একসময় দেশের বেশির ভাগ মোটরসাইকেল ছিল ৮০ থেকে ১০০ সিসির। এখন ১৬৫ সিসির মোটরসাইকেল আছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, ২৫০ সিসির বেশি ইঞ্জিন ক্ষমতার মোটরসাইকেল তৈরি করতে দেশে কারখানা হচ্ছে।
এ ছাড়া গত বছর বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে সিসির সীমা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সিসির সঙ্গে গতির কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সিসির সঙ্গে গতি তোলার সম্পর্ক নেই।
তবে সিসি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, অতিরিক্ত সিসির মোটরসাইকেলে খুব অল্প সময়ে উচ্চ গতি তোলা যায়। অতিরিক্ত গতির কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে।
হেলমেটের মান পরীক্ষা শুরু
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সঠিকভাবে হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে।
বুয়েটের গবেষণার তথ্য বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৮৮ শতাংশই দুর্ঘটনায় সময় হেলমেট পরা ছিলেন না। এ ছাড়া মোটরসাইকেলচালকদের ৬৬ শতাংশ নিয়মিত হেলমেট ব্যবহার করেন না।
গবেষণায় দেখা গেছে, তুলনামূলক হেলমেট ব্যবহারের হার ঢাকায় বেশি। এই মহানগরের চালকদের ৯৯ দশমিক ৮ শতাংশ ও যাত্রীদের ৯৬ দশমিক ৩ শতাংশ হেলমেট পরেন। বরিশালে এ হার যথাক্রমে ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৮ দশমিক ১ শতাংশ।
তবে হেলমেটের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাজারে চার ধরনের হেলমেট পাওয়া যায়: ফুল ফেস, হাফ-ওপেন ফেস, ওপেন ফেস ও অন্যান্য। তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ ফুল ফেস হেলমেট, কিন্তু এ ধরনের হেলমেট পরেন মাত্র ১১ শতাংশ চালক।
হেলমেটের মান দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। তবে গত এপ্রিল পর্যন্ত হেলমেট পরীক্ষার জন্য সরকারি সংস্থাটির পরীক্ষাগারই ছিল না।
বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক খালিদ রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গত মাসে তাঁরা হেলমেটের মান পরীক্ষা শুরু করেছেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই আমদানি করা হেলমেটের চালান দেশে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, কিছুদিন পর থেকে বাজারে থাকা মানহীন হেলমেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।
নিরাপত্তাসংক্রান্ত নিয়ম মানতে হবে
বুয়েটের গবেষকদের মতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি অন্য বাহনের চেয়ে ২৬ গুণ বেশি। দেশে অর্ধেকের বেশি দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। এরপর ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে অসতর্কভাবে মোটরসাইকেল চালনায়।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের সড়ক মোটরসাইকেলের জন্য উপযোগী নয়। উন্নত দেশে মোটরসাইকেল ও সাইকেলের জন্য আলাদা লেন আছে। ফলে দুর্ঘটনা কম হয়। কিন্তু দেশে সব ধরনের যানবাহন এক রাস্তায় চলে। এ ছাড়া ব্যবহারকারীরাও সচেতন নন।
কীভাবে দুর্ঘটনা কমানো যায়—এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, মানসম্মত হেলমেট ব্যবহারের পাশাপাশি গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। চালকদের সচেতন হতে হবে। সবাইকে সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত নিয়ম মেনে চলতে হবে।