ম্যালেরিয়ার ভয় কমেছে পাহাড়ে

পার্বত্য চুক্তির পর ম্যালেরিয়া নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি জোর তৎপরতা শুরু হয়। পাহাড়ে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা বড় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

  • তিন পার্বত্য জেলায় ২০১০ সাল থেকেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কমতে থাকে। এরপর কিছুটা বাড়ে ২০১৪ সালে।

  • ২০১৪ সালে পার্বত্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৮০। পরের বছর এ সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশি।

  • ২০১৮ সালে এ সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে হয় ৯ হাজার ৫৩৯।

ছবি: প্রথম আলো

রাঙামাটির জুরাছড়ির বিজয়লক্ষ্মী চাকমা (৬৮) যখন ছোট, তখন তাঁকে নিয়ে অভিভাবকদের ভয় ছিল বিস্তর। তিনি যখন অভিভাবক হয়েছেন, তখনো পরিবারের সন্তানদের নিয়ে তাঁকে ভয়ে থাকতে হতো। দুই সময়েই ভয়ের উৎস ম্যালেরিয়া। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক বিজয়লক্ষ্মীর ভয় এখন দূর হয়েছে। জুরাছড়ি সদরের ধামাইপাড়ার এই বাসিন্দা বলছিলেন, আগে ম্যালেরিয়া আসত মৃত্যুর ভয় নিয়ে। এখন সেটা একটা সাদামাটা রোগে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসা দোরগোড়ায়। তাই ভয় কম।

বাংলাদেশের ১৩টি জেলা ম্যালেরিয়াপ্রবণ। এর মধ্যে পার্বত্য তিন জেলা সবচেয়ে বেশি। রাঙামাটির উপজেলাগুলোর মধ্যে জুরাছড়ি অন্যতম ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা। এখন সেখানে প্রকোপ কম। গত আট বছরে মৃত্যুর কোনো সংবাদই নেই। রাঙামাটি জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২০০২ সালে সেখানে ম্যালেরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ছিল ১৪৩। ২০১৪ থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৃত্যুর ঘটনা একটি, ২০১৬ সালে।

২০১৭ সালে জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ২৮৭। পরের বছর ৩ হাজার ৬। ২০১৯ সালে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ বেড়ে হয় ৬ হাজার ৬৬। দীর্ঘ বর্ষা, মশারির কার্যকারিতা কমে যাওয়া—এগুলোকেই বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন রাঙামাটির সিভিল সার্জন বিপাশ খীসা। এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১৯৮ জন আক্রান্ত হয়েছে।

বিপাশ খীসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন প্রত্যন্ত এলাকা ছাড়া শহর এলাকাগুলোতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ প্রায় নেই।’

পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে বান্দরবানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। তবে জেলার সবচেয়ে দুর্গম ও ম্যালেরিয়াপ্রবণ থানচিতেও এখন পৌঁছে গেছে স্বাস্থ্য পরিষেবা। জেলার থানচির হেডম্যানপাড়ায় ১১৫টি মারমা পরিবারের বসবাস। আট-নয় বছর আগেও প্রতিবছর শতাধিক মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতো। কারও কারও মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু এখন আক্রান্ত বছরে ১৪ থেকে ১৫ জনে নেমে এসেছে। মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যের কোঠায়।

হেডম্যানপাড়ার বাসিন্দা ও থানচি সদর ইউনিয়নের সদস্য উসাই অং মারমা বলেন, ‘আগে ম্যালেরিয়া হলে ভাবতাম, বাঁচার উপায় নেই। এখন সে ভয় নেই। কারও সামান্য জ্বর হলে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অথবা ব্র্যাক ম্যালেরিয়া চিকিৎসাকেন্দ্রে রক্ত পরীক্ষা করেন।’

এ গ্রামে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের মশারি বিতরণ করা হয়েছে। মানুষ সেই মশারি ব্যবহার করছে।

বান্দরবান সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যে জানা গেছে, থানচিতে ২০১৪ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ১৮৯। গত বছর এটি অর্ধেকে নেমে আসে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রোগী ছিল ৪৮০ জন।

এভাবে পাহাড়ের প্রতিটি জনপদে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসার চিত্র দেখা যায়।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলায় ২০১০ সাল থেকেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কমতে থাকে। এরপর কিছুটা বাড়ে ২০১৪ সালে। সেই সময় এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৮০। পরের বছর ১৮ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৩৯।

প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো, দ্রুত ম্যালেরিয়া শনাক্তে সক্ষম কিটের বিস্তার, কীটনাশকযুক্ত মশারি সহজলভ্য করা—এসবের ফলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়ার বিস্তার রোধে সাফল্য এসেছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।

ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এম এ ফয়েজের কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমে আসাটা সরকারি-বেসরকারি মিলিত তৎপরতার ফসল।

যৌথ কার্যক্রমের সূচনা

একাধিক ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়ে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হলেও আগে এ নিয়ে তেমন তৎপরতা ছিল না। ১৯৬০-এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালরিয়া নির্মূলে সরকারি তৎপরতা শুরু হয়। তবে সে প্রচেষ্টা খুব বেশি সফল হয়নি। ১৯৭০-এর দশকে সশস্ত্র লড়াইয়ের কারণে অশান্ত হয়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সে লড়াই চলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে। ১৯৮০-এর দশকে এসে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আরও বাড়তে শুরু করে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করা জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) চুক্তির পর পাহাড় শান্ত হয়। তারপর সেখানে জোরেশোরে শুরু হয় বিভিন্ন উন্নয়ন তৎপরতা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সরকারের তৎপরতার পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাক যুক্ত হয় ১৯৯৮ সালে, পার্বত্য চুক্তির ঠিক পরের বছর। প্রতিষ্ঠানটি তখন নিজের অর্থায়নেই এ কাজ করত। সে বছর পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলায় পাইলট প্রকল্প শুরু করে ব্র্যাক। ২০০৫ সালের মধ্যে সংস্থাটি ২৫টি উপজেলায় কাজের পরিধি বাড়ায়। কীটনাশকে চোবানো মশারি বিতরণ, নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা এবং ওষুধ দেওয়া—এই তিন কাজ করত ব্র্যাক।

২০০৩ সাল থেকে সেখানে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) নেতৃত্বে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাজ শুরু হয়। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এ কর্মকাণ্ডে স্বাস্থ্য ছিল একটি বড় উপাদান। ২০০৭ সালে গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস, টিউবারকিউলোসিস অ্যান্ড ম্যালেরিয়া প্রকল্পের আওতায় ম্যালেরিয়া নির্মূলে জোর তৎপরতা শুরু হয়। এতে সরকারের সঙ্গে যোগ দেয় ব্র্যাকসহ আরও কিছু বেসরকারি সংস্থা। উন্নয়ন তৎপরতা শুরু হওয়ার পর প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছায়। এর সুফল পায় দূর পাহাড়ের মানুষ।

ব্র্যাকের সংক্রামক ব্যাধি ও ওয়াশ কর্মসূচির পরিচালক মো. আকরামুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি একটা বড় মাইলফলক। এটি না হলে আমরাও হয়তো সে সময় পাহাড়ে যেতাম না। আমরা তখন দেখেছিলাম, পাহাড়ের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা ম্যালেরিয়া। আর তার ওপর নির্ভর করছে অন্য সব উন্নয়নকাজ।’

এখন পাহাড়ের প্রতিটি পাড়ায় আছেন একজন করে স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁরা মূলত ব্র্যাকের কর্মী। তাঁদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। তাঁদের বেতন, প্রশিক্ষণ—সবই সরকারি খরচে হয়। মশারি, র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ও প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহও হয় সরকারি খরচে। শুধু বিতরণে থাকেন ব্র্যাকের কর্মীরা। আর ব্র্যাকের এসব কাজ পর্যবেক্ষণ করে সরকার।

নির্মূলে এখনো যত প্রতিবন্ধকতা

এত সব তৎপরতার পরও বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি পার্বত্য তিন জেলার। গত বছর দেশে ১৭ হাজার ২২৫ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলাতেই আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ৪১৪। অর্থাৎ আক্রান্তের ৯৫ শতাংশ পার্বত্য এলাকার। আবার পার্বত্য ৩ জেলার মধ্যে ৫৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে বান্দরবানে। ১৩টি জেলার মধ্যে পার্বত্য ৩ জেলা এখনো ম্যালেরিয়ার ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত।

পাহাড়ে ম্যালেরিয়া নির্মূলের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা বললেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে একটি হলো দুর্গমতা, অন্যটি সরকারি স্তরে জনবলের অভাব।

এখনো পাহাড়ের যেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, সেগুলো বেশ দুর্গম অঞ্চল। যেমন বান্দরবানের থানচি, আলীকদম কিংবা লামা। আবার রাঙামাটির ১০ উপজেলার ৬ উপজেলায় যোগাযোগ হয় জলপথে। দুর্গম বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়িতে সংক্রমণ হয় সবচেয়ে বেশি। খাগড়াছড়ি উপজেলার মধ্যে লক্ষ্মীছড়িতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। এর যোগাযোগব্যবস্থাও অন্যান্য উপজেলার চেয়ে খারাপ।

ম্যালেরিয়ার বিশেষজ্ঞ এম এ ফয়েজ বলেন, ‘জুমে গিয়ে অনেকে আক্রান্ত হন। আবার গাছ বা বাঁশের খোঁজে বনে যাওয়া ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হন। বনে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসতে আসতে দেরি হয়ে যায়। এরপর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার অবস্থাও অনেকের থাকে না।’

দুই দশকের বেশি সময় ধরে পার্বত্য এলাকার জরুরি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে একাধিক প্রকল্পে কাজ করেছেন রাঙামাটি সদরের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বিনোদ শেখর চাকমা। দুর্গমতার কারণে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ বাড়ার উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবছর ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ১-এর (প্রতি হাজারে একজন) নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। সদর উপজেলায় এখন হাজার জনে সংক্রমণের হার দশমিক ৪৬ শতাংশ। কিন্তু বরকলের মতো দুর্গম এলাকায় এ হার ২-এর ওপরে।

দুর্গমতা ও জনবলের পাশাপাশি পাহাড়ের রাজনৈতিক হানাহানিরও একটি নেতিবাচক প্রভাব আছে বলে মনে করেন জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এডিস রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক আফসানা আলমগীর খান। তিনি বলেন ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি আছে বাংলাদেশ সরকারের।