যতই করি, তারপরও বলে এটা হলো না, ওটা হলো না কেন?

আজ বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণ দেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনাছবি: পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি মিডিয়া বা টক শো দেখে দেশ পরিচালনা করেন না। তিনি দেশ পরিচালনা করেন অন্তর থেকে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে তিনি দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন, এগিয়ে নেবেন।

আজ বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। দীর্ঘ বক্তব্যে তিনি বিএনপি আমলের ব্যর্থতা এবং বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন। কঠোর সমালোচনা করেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের।

সরকারের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের মানুষের একটা বদভ্যাসও আছে। কথায় কথায় হতাশ হওয়া। যতই কাজ করি, তারপরও বলে এটা হলো না কেন? ওটা হলো না কেন? আমি বলতে চাই, এসব না করে আগে কী ছিল আর এখন কী হয়েছে, সেটা দেখলে তো হয়ে যায়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিডিয়া কী লিখল আর টক শোতে কী বলল, সেটা শুনে আমি কখনো দেশ পরিচালনা করি না। দেশ পরিচালনা করি আমার অন্তর থেকে। কারণ, আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করেছেন। দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। সেই মানুষগুলোর জন্য কী কাজ করতে হবে, সেটা আমি বাবা-মায়ের থেকে শিখেছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার দারিদ্র্য ৪০ ভাগ ছিল ২০ ভাগে নামিয়েছে। করোনায় কিছু মানুষ কাজ পাচ্ছে না। কিন্তু একেবারে না খেয়ে কেউ নেই। দারিদ্র্যের হার বাড়তে পারে, কিন্তু ২০ ভাগ থেকে ৪০ ভাগ হয়ে গেছে এটা ঠিক না। তিনি বলেন, করোনার মধ্যেও রেমিট্যান্স বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। বিএনপির সময় রিজার্ভ ছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। আজকে ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ।

সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। বিশ্বব্যাংক বা কেউ এখানে দুর্নীতির প্রমাণ করতে পারেনি। এখন পদ্মা সেতু দৃশ্যমান, মেট্রোরেল দৃশ্যমান। ঢাকাজুড়ে মেট্রোরেল ও যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করা হবে।

দীর্ঘ বক্তব্যে তিনি বিএনপি আমলের ব্যর্থতা এবং বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ছবি: পিআইডি

শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে বলছেন স্বাস্থ্য খাত একেবারে শেষ হয়ে গেছে। আগের সঙ্গে তুলনা করলেই হয়। দেশের অনেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যেতেন। করোনার কারণে অনেকে এবার যেতে পারেননি। দেশে চিকিৎসা করতে হয়েছে। দেশে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই যাতে করোনার টিকা পায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভ্যাকসিনের কোনো সমস্যা নেই। ২৪ কোটি ডোজ টিকা কেনা হবে। টিকা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। দেশেও টিকা উৎপাদন করা হবে।

বন্ধুত্বের নিদর্শন ও বাজারজাতকরণে আম পাঠানো হয়েছে

পাকিস্তানে আম পাঠানো নিয়ে বিএনপির হারুনুর রশীদের বক্তব্যের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, কেবল পাকিস্তান নয়, ভারতসহ আশপাশের প্রতিবেশী দেশ, এমনকি মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সব দেশেই আম পাঠানো হয়েছে। আম পাঠানোর একটা কারণ হচ্ছে বন্ধুত্বের নিদর্শন এবং দ্বিতীয়টি হলো বাজারজাতকরণ। সে জন্য সবাইকে আম পাঠানো হয়েছে। তবে একাত্তরে পাকিস্তান যে অত্যাচার করেছে, সেটা নিশ্চয়ই ভোলা যায় না। এটা ভুলে গিয়েছিল বিএনপি।

জিয়াকে হত্যা মামলার আসামি করা উচিত ছিল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি জিয়াকে হত্যা মামলার আসামি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব রেজাউল হায়াত তাঁকে জানান, মৃত ব্যক্তিকে আসামি করা যায় না। এ কারণে তা করা হয়নি। কিন্তু তাঁকে আসামি করা উচিত ছিল। কারণ, জিয়া যে ষড়যন্ত্রে জড়িত, তা ফারুক-রশিদ নিজেরাই বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়ার আমলে প্রতিটি কারাগারে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আর তারা এখন আইনের শাসন, মানবাধিকারের কথা বলে। তিনি দলীয় সাংসদদের ওই সময়ে কারাগারে কাদের কাদের হত্যা করা হয়েছে, তা খুঁজে বের করতে বলেন।

জিয়ার লাশের নামে বাক্স

রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবর
ফাইল ছবি

সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে কথা উঠছে। ৪০ বছর পরে নয়, জিয়ার মৃত্যুর সংবাদের পরে তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। গায়েবানা জানাজা হয়েছিল। কয়েক দিন পরে একটি বাক্সে আনা হলো। এখানে কেউ একটা বুদ্ধি দিয়েছে, আর জেনারেল এরশাদ তো এই বিষয়ে বেশি পারদর্শী। সাজিয়েগুজিয়ে একখানা বাক্স নিয়ে এসে দেখানো হলো।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জিয়ার লাশ শনাক্ত করেছিলেন মীর শওকত। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে চিনতাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সত্যি কথা বলেন তো? বলেছিলেন, লাশ কোথায় পাব? জেনারেল এরশাদ সাহেব তাঁকে আমি বললাম, আপনি যে একটা বাক্স আনলেন, লাশটা কই? আমাকে বললেন, বোন, লাশ পাব কোথায়?’

যেখানে জাতির পিতা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সব ব্যবস্থা করে দেশ স্বাধীন করেছেন, সেখানে একজন মেজর একখানা ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে একটা বক্তব্য দিলেন আর দেশ স্বাধীন হলে গেল? সবাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল? এটা হয়?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু তাঁকে খেতাব দিয়েছেন। তা সবই সত্য। কিন্তু তাঁর অবদানটা কী? মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কর্নেল আসলাম বেগ তাঁকে চিঠি লিখেছিল। ওই চিঠি আমার কাছে আছে। এই সংসদে সেটা তুলে ধরব।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘কর্নেল আসলাম বেগ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিয়াকে চিঠিতে লিখেছিল, ‌আপনি খুব ভালো কাজ করছেন। আমরা আপনার কাজে সন্তুষ্ট। আপনার স্ত্রী–পুত্রকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনাকে ভবিষ্যতে আরও কাজ দেওয়া হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না। তিনি ছিলেন অধিনায়ক। খালেদ মোশাররফ আহত হলে মেজর হায়দার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপিরই একজন সাংসদ বলেছেন, সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে জিয়া যেখানে অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন সেখানে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, তাহলে জিয়া কী কাজ করেছেন? পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন কি না?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেখানে জাতির পিতা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সব ব্যবস্থা করে দেশ স্বাধীন করেছেন, সেখানে একজন মেজর একখানা ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে একটা বক্তব্য দিলেন আর দেশ স্বাধীন হলে গেল? সবাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল? এটা হয়?’

দুদককে তদন্ত চালু রাখতে হবে

মুজিবর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের দেওয়া ঘর নিয়ে দুর্নীতি বা অনিয়মের তদন্ত চালু রাখার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত বন্ধ করবে কেন? তাদের তো তদন্ত বন্ধ করার কথা নয়। তাদের তদন্ত চালু রাখতে হবে।

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ভেঙে পড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর
ফাইল ছবি

তদন্ত করে দেখতে হবে, যারা ঘর ভেঙেছে, তারা কারা, তাদের উদ্দেশ্য কী। ৩০০টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিটি তদন্ত তাদের করতে হবে এবং রিপোর্ট দিতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, এক সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন, আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। এটা তদন্ত হয়েছে। ৯টি জায়গায় দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আর দশ-বারোটি জায়গায় অতিবৃষ্টির কারণে মাটি ধসে ঘর পড়ে গেছে। আর ৩০০টি জায়গায় দরজা-জানালার ওপর হাতুড়ির আঘাত দেখা গেছে। ফ্লোরগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোলা হয়েছে। এসবের ছবি আছে। ইটের গাঁথুনির পিলার ভেঙে ফেলা হয়েছে। এটা তো দুর্নীতির জন্য হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কারা করল? তবে হ্যাঁ, কারা করছে, তদন্ত হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু অ্যারেস্ট হয়েছে। অন্যদের অ্যারেস্ট করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা গরিবকে ঘর করে দেব, সেখান থেকেও টাকা মেরে খাবে? আমরা এখন কংক্রিট এবং স্টিল দিয়ে ঘর করে দিচ্ছি। যাতে সহজে কেউ ভাঙতে না পারে।’