যানজটে বিপর্যস্ত পাবনা শহর

দুর্বিষহ যানজটে স্বাভাবিক পথচলা ব্যাহত হচ্ছে পাবনা শহরবাসীর। ছবিটি শহরের আবদুল হামিদ সড়কের ট্রাফিক মোড় থেকে তোলা l প্রথম আলো
দুর্বিষহ যানজটে স্বাভাবিক পথচলা ব্যাহত হচ্ছে পাবনা শহরবাসীর। ছবিটি শহরের আবদুল হামিদ সড়কের ট্রাফিক মোড় থেকে তোলা l প্রথম আলো

কাগজ-কলমে নাম ‘খেয়াঘাট মোড়’। তবে লোকমুখে পাবনা শহরের কেন্দ্রীয় এলাকায় এই স্থানের নয়া পরিচিতি ‘যানজটের মোড়’ নামে। প্রতিদিন সকাল থেকে শহরে যে দুর্বিষহ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, তার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র এই মোড়। নতুন নামকরণ সে কারণেই।
শহরের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে তাঁদের সমস্যা নিয়ে গত তিন দিন কথা বলে জানা গেল, যানজটকেই তাঁরা প্রধান সমস্যা মনে করেন। চলাচলের দুর্ভোগ তো আছেই, ব্যবসা-বাণিজ্য, সন্তানদের লেখাপড়া, জরুরি চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রেই যানজট শহরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অনেকটা ব্যাহত করছে। তবে জেলার পুলিশ সুপার আলমগীর কবীর বলেছেন, শিগগির এই যানজটের দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাওয়ার সমাধান নেই।
গতকাল রোববার কথা হয় গৃহবধূ শুক্লা সান্যালের সঙ্গে। আবদুল হামিদ সড়কের ইন্দিরা মোড়ে রিকশায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে সাগ্নিক মজুমদারকে নিয়ে জটে আটকে ছিলেন। ছেলের স্কুল শালগাড়িয়ায়। তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। তিনি বললেন, ‘সমস্যা হয় ইন্দিরা মোড় থেকে খেয়াঘাট মোড় পর্যন্ত। দুই মোড়ের দূরত্ব বড়জোর ৫০০ গজ। এই পথটুকু যেতেই অন্তত ৪৫ মিনিট, কোনো কোনো দিন তারও বেশি সময় লাগে, যা অসহ্য।’
শহর ঘুরে দেখা গেল, যানজট সৃষ্টি হচ্ছে মূলত দক্ষিণে ইন্দিরা মোড়, উত্তর দিকে হাসপাতাল রোড মোড়, পশ্চিমে ট্রাফিক মোড়, পূর্ব দিকে আতাইকুলা রোডের সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ এলাকা থেকে। এর মাঝখানে শহরের কেন্দ্র এলাকা। পুরো এলাকাটি প্রায় সারা দিন যানজটে প্রায় স্থবির হয়ে থাকে। এর প্রভাব পড়ে আশপাশে পাড়া-মহল্লার সংযোগ সড়কগুলোতে। মহল্লার সড়কগুলো তেমন প্রশস্ত নয়। চালকেরা কখনো কখনো লাইন ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে জটিল ৩জটলার সৃষ্টি করেন। এ ধরনের যানজট সৃষ্টি হচ্ছে জয়কালিবাড়ী সড়ক, বিনা-বাণী সিনেমা হল মোড়, ডায়াবেটিস হাসপাতালের সামনের মোড়, মুক্তমঞ্চের মোড়, পাঁচ মাথার মোড়, চাঁপা মসজিদ মোড়, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ মোড়, আলিয়া মাদ্রাসা মোড় এলাকায়।
এ ছাড়া প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশের ফুটপাতে বসছে নানা পণ্যের পসরা। কোথাও কোথাও পণ্যের পসরা নেমেছে মূল সড়কে। এটিও যানজটের অন্যতম কারণ। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বললেন, যে মার্কেটের সামনে পসরা বসান, সেই মার্কেটের দোকান মালিকদের কাছ থেকে তাঁরা সামনের অংশ ভাড়া নিয়েছেন। তবে পাবনা পৌরসভার মেয়র কামরুল হাসান বললেন, এভাবে ভাড়া দেওয়া বা নেওয়া অবৈধ।
আবার কোনো কোনো জায়গায় পুলিশকে মাসোহারা দেওয়ার কথা বললেন ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা।
শহরের মোড়গুলোই প্রধানত যানজটের উৎস। এসব মোড়ে দুই বা তিনটি সড়ক এসে মিশেছে। সেসব সড়ক থেকে আসা রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটো, অটোরিকশা, ভটভটি জড়ো হচ্ছে মোড়ে। একসঙ্গে চালকেরা সবাই রাস্তা পারাপারের চেষ্টা করছেন। তীব্র শব্দে হর্ন বাজাচ্ছেন। রাত আটটার আগে শহরে বাস-ট্রাক-মিনিবাস প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু সারা দিনই আন্তজেলা পথের মিনিবাসগুলো বাইপাস সড়ক দিয়ে না গিয়ে শহরের ভেতর ট্রাফিক মোড় দিয়ে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে যাতায়াত করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের যাতায়াতের বাসগুলো তো চলছেই। এসব বাস শহরে ঢুকলে যানজট আরও বাড়ে। শহরের অধিকাংশ মোড়েই ট্রাফিক পুলিশ নেই।
শহরের প্রধান পাইকারি ও খুচরা বাজারের নাম বড় বাজার। প্রবেশের প্রধান পথ একটিই, হাজি মো. মহসীন সড়ক। এই সরু পথ দিয়েই রিকশা, অটো চলছে, ঠেলাগাড়িতে আনা-নেওয়া হচ্ছে মালামালের বস্তা, কার্টন, ঝুড়ি।
পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাহাবুব উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যানজটে শহর বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা অনেকবার এ নিয়ে জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় প্রশাসনকে বলেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয় না।’
পাবনা পৌরসভায় মহল্লা ৩৪টি। পৌরসভার হিসাব অনুসারে কংক্রিটের রাস্তা ১৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার, কার্পেটিং ১৫১ কিলোমিটার। শহরে পৌরসভার অনুমোদিত রিকশা ৪ হাজার, অননুমোদিত প্রায় ৫ হাজার। এর সঙ্গে অটোরিকশা, অটো, ভটভটি আরও ৬ হাজার। মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলা থেকে অসংখ্য ভটভটি, অটো, স্কুটার, ট্রাক, বাস, মিনিবাস শহরে ঢুকছে।
পৌরসভার মেয়র কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, শহরের রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন নেমেছে। ফলে যানজট নিরসন করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ বাড়িই পুরোনো। ফলে রাস্তাও প্রশস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘ব্যাটারির অটো পথে নামাতে অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। এই যানটিই যানজটের প্রধান কারণ। চালকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটি অবৈধ যান। কিন্তু এর আমদানি নিষিদ্ধ নয়। আমরা এটি তুলে দেব কেমন করে? সংকট সমাধান করতে হলে আমদানি বন্ধ করতে হবে।’ ফুটপাতের পসরা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, কিন্তু তারপর আবার তারা বসে যায়। এ সত্ত্বেও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি।’
শহরের যানজট নিরসনের দ্রুত কোনো সমাধান নেই বলে জানালেন পুলিশ সুপার আলমগীর কবীর। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি কারণে এই শহরকে যানজটমুক্ত করা কঠিন। প্রথমত, শহরে কোনো বিকল্প সড়ক নেই। একটিমাত্র প্রধান সড়কের ওপর নির্ভর করে পুরোনো শহরটি গড়ে উঠেছে। আবদুল হামিদ সড়কের দুই পাশে গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা। দ্বিতীয়ত, পুলিশের লোকবলের অভাব। কর্মকর্তাসহ জেলায় ট্রাফিক পুলিশের জনবল ৬০। পাবনা শহরে ৪০ জন। তবে আছেন ২৬ জন। কনস্টেবল ২১ জন। এর মধ্যে ছুটিছাটা, প্রশিক্ষণ এসবে থাকেন অন্তত চারজন। বাকিরা দুই পালায় কাজ করেন। ফলে এত বড় শহরের যানজট সামাল দেওয়া কঠিন। তৃতীয়ত, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অটো, ভটভটি—এসবের কোনো নির্ধারিত স্ট্যান্ড নেই। তারা নিজেদের সুবিধামতো বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকার মোড়ে স্ট্যান্ড করেছে। সরিয়ে দিলেও আবার সেই জায়গায় ফিরে আসে। তবু যতটা সম্ভব মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশের উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, সবার বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ ঠিক নয়। হয়তো ব্যক্তিগতভাবে কেউ সুযোগ নিতে পারে।